
মাহবুব হোসেন ও আবু জাফর সিদ্দিকী:
মামলার তদন্তকারী দুইজন কর্মকর্তা ও আইনজীবির গাফিলতির কারণে বিনা দোষে ৫৯দিন কারাভোগ করেও মামলা থেকে মুক্তি পায়নি নাটোরের সিংড়ার আঁচলকোট গ্রামের বাবলু শেখ। বর্তমানে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে বাবুল শেখকে।
অনুসন্ধান বলছে, নাটোরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতের একটি মারামারির মামলায় সিংড়া উপজেলার আঁচলকোট গ্রামের শ্রী দেবদাসের ছেলে শ্রী বাবু কে দুই বছরের দন্ডাদেশ দেয় আদালত। কিন্তু তার পরিবর্তে কারাগারে পাঠানো হয় ইয়াকুব আলীর ছেলে বাবলু শেখ নামের একজন চা বিক্রেতাকে। বিনা অপরাধে শ্রী বাবুর পরিবর্তে ৫৯ দিন কারাভোগ করেন বাবুল শেখ।
এদিকে, ১৫ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে বিচারক সাইফুর রহমান সিদ্দিকীর আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের শুনানি রয়েছে।
আদালতের নথিপত্র ও বাদীর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল নাটোর সদর উপজেলার গাঙ্গইল গ্রামে একটি মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কাজী আবদুল মালেক বাদী হয়ে শ্রী বাবুসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে নাটোর সদর থানায় ১৮/০৪/২০০১ তারিখে একটি মামলা দায়ের করেন। যার মামলার নম্বর ১৪।
তৎকালীন নাটোর সদর থানার উপ-পরিদর্শক মমিনুল ইসলাম শ্রী বাবুকে অভিযুক্ত করে ১৫/০৫/২০০১ তারিখে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। পরবর্তীতে একই বছরের ২৮শে ডিসেম্বর পুনরায় শ্রী বাবুকে অভিযুক্ত করে সদর থানার উপ-পরিদর্শক হেলেনা পারভীন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
কিন্তু মামলার এজাহারে উল্লেখিত আসামি বাবুকে গ্রেপ্তার না করে ইয়াকুব আলীর ছেলে বাবলু শেখকে ২০০২ সালের ৭ নভেম্বর গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ।
এই ভুলের বিষয়টি আদালতকে অবহিত না করে ছয় দিন পর ১৩ নভেম্বর আসামির আইনজীবী বাবু পরিচয়েই বাবলু শেখের জামিন করান। পরে ওই পরিচয়েই বাবলু শেখের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ ও আসামি পরীক্ষা করেন। যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৬ সালের ২৩ জুন মুখ্য বিচারিক হাকিম মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী আসামি বাবুর বিরুদ্ধে দুই বছর সশ্রম কারাদন্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ দেন। ওই দিন কাঠগড়া থেকে বাবলু শেখকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি ১৬/০৮/১৬ তারিখে আপিলের মাধ্যমে জামিনে বের হন।
এদিকে, মূল ঘটনা জানতে যাওয়া হয় সদর উপজেলার গাঙ্গইল গ্রামে। কথা হয় মামলার বাদী কাজী আব্দুল মালেকের স্ত্রী ওলেগান বেগমের সাথে। তিনি বলেন, তার স্বামী প্রায় ১৫ বছর আগে মারা গেছেন। তিনিসহ পরিবারের সবাই জানে এ মামলার কার্যক্রম এতদিনে স্থগিত হয়ে গেছে।
কাজী আব্দুল মালেকের ছেলে ও মামলার সাক্ষী বাতেন কাজী বলেন, আমরা জানি যে, এতদিনে এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেছে। সংবাদকর্মী পরিচয় পেলে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি।
একই গ্রামের বাসিন্দা ও এ মামলার সাক্ষী নবীউল্লাহ বলেন, শ্রী বাবু নামের কেউ অত্র এলাকায় নাই। তবে যে বাবলু শেখকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল এ মামলার সাথে তার সম্পৃক্ততা নেই।
আঁচলকোট গ্রামে গেলে কথা হয় গ্রামের বাসিন্দা মকছেদ আলী প্রাং, জনাব আলী ও গ্রাম্য ডাক্তার বিশনাথ সরকারের সাথে, তারা জানায় অত্র এলাকায় শ্রী বাবু নামের কেউ কোনদিনই ছিলনা, বাবলু শেখ এলাকার একজন সহজ-সরল মানুষ। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে।
আসামী বাবলু শেখ বলেন, আমি বাবলু শেখ, শ্রী বাবু না। আমি একজন নিরীহ ও সহজ-সরল মানুষ। অন্য আসামিদের সঙ্গে তিনি দিনের পর দিন আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। সাক্ষ্য গ্রহণের সময় ভুল পরিচয়ের বিষয়টি জানার পর আইনজীবীর মাধ্যমে তাঁর ভোটার পরিচয়পত্র আদালতে জমা দিয়ে ঘটনায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু তাতেও সমাধান পাইনি। তাই বিনা অপরাধে দুইবারে ৫৯ দিন কারাভোগ করেছি।
বাবলু শেখের অন্যতম আইনজীবী দেওয়ান লুৎফর রহমান বলেন, বাবলু শেখের জামিনের সময় অন্য আইনজীবী ছিলেন। তিনি দাবি করেন, পরে আমি বাবলু শেখের জাতীয় পরিচয়পত্র আদালতে উপস্থাপন করে ত্রুটির বিষয়টি অবগত করেছি। এরপরও তাঁর সাজা হওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক।
বাবলু শেখের বর্তমান আইনজীবি শামীম উদ্দিন বলেন, মামলার তদন্তকারী দুইজন কর্মকর্তা ও আগের আইনজীবির গাফিলতির কারণে বিনা দোষে কারাভোগ করতে হয়েছে বাবলু শেখকে। কোন আসামীর নাম ঠিকানায় না পাওয়া গেলে এমনিতে মামলা থেকে অব্যাহতি পাবে, কিন্তু তৎকালীন পুলিশ সদস্যরা তাদের কাজের গাফিলতি দেখিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কারাদন্ডের দুই বছরের বিরুদ্ধে আমরা আপীল করেছে। ১৫সেপ্টেম্বর সে আপিলের শুনানী হবে। আশা করছি বাবুল শেখ এই মামলা থেকে মুক্তি পাবে।
নাটোর সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফরিদুল ইসলাম বলেন, অনেক আগের বিষয়, না জেনে বলতে পারছি না। খোঁজ-খবর নিয়ে পরে বলতে পারব।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, আমি যেহেতু নতুন যোগদান করেছি, সেকারনে বিষয়টি আমার জানা নেই। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে দেখবো।
