Home মুক্তমত আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে করণীয়

আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে করণীয়

751
0

মাতৃভাষা প্রতিটি জাতির জীবন উপাখ্যান রচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কোন দেশের নৃ-তাত্বিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাহক হলো সেদেশের আদিবাসীরা। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য সংস্কৃতি। ভাষা ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। তাই ভাষাকে সংরক্ষণ করতে না পারলে সংস্কৃতি সংরক্ষণ অসম্ভব। কালের বিবর্তনে আদিবাসীদের এই ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো আদিবাসী ভাষাভাষী মানুষের ব্যবহৃত মাতৃভাষার লিখিত রুপ বা বর্ণমালা নেই এবং এসব সংরক্ষনের জন্য সরকারি-বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যেগ নেওয়া হয়নি কখনও।

আদিবাসীদের রয়েছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ভূমিসংলগ্ন জীবন-জীবিকা, ধর্ম এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো। কিছু কিছু ধারণ করে ঐতিহ্যগত জীবন পদ্ধতি। তারা মূলত নিজেদের মৌলিক পরিচিতিটাকে বজায় রাখতে চায়। কিন্তু নিজেদের স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও আদিবাসীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বৈষম্য, দারিদ্র, স্বার্থহীনতা, বেকারত্ব প্রভৃতির শিকার। তাদের ভূমি ও সম্পদ, বনায়ন, খনি, বাঁধ, সড়ক নির্মাণ, রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশন, পারমাণবিক পরীক্ষা, সেচ প্রকল্প প্রভৃতি ক্ষতিকারক উন্নয়ন কাজের কারণে আজ হুমকির সম্মুখীন।

আমাদের দেশের আদিবাসীরা নিজের ভাষাকে ভালোবাসে কিন্তু অন্য ভাষাকেও স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার মানসিকতা ও আগ্রহ রয়েছে ব্যাপক। সেজন্য দেখা যায় একজন শিক্ষিত আদিবাসী একজন বাঙালি থেকে দু’একটি ভাষা বেশি জানে। কিন্তু চর্চা ও সংরক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব ভাষা লোপ পেয়ে মূলস্রোতধারার ভাষায় বেশি প্রধান্য পাচ্ছে। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা হয়তো একেবারেই চর্চা করছে না আর মাতৃভাষার। অনেক আদিবাসী মায়েদের নিজস্ব ভাষা সম্পর্কে অনেক সচেতন হওয়া উচিত। ইদানিং আদিবাসী গ্রামগুলোতে লক্ষ্য করা যায়, অনেক মা-বাবারা সন্তানদের সাথে বাংলা ভাষায় অনর্গল কথা বলেন। এটা কিন্তু মোটেও উচিত নয়। বাংলা ভাষা শিখবে, বাংলা ছাড়া ইংরেজী সম্ভব হলে আরো অন্যান্য ভাষাও অবশ্যই শিখবে, কিন্তু মাতৃভাষাটা আগে শেখা দরকার। সন্তানদের মাতৃভাষায় চর্চা সব শেখানো দরকার। না হলে মাতৃভাষা শিখবে কেমনে। সকল আদিবাসীদের মাতৃভাষা চর্চা ও সংরক্ষনে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। তা না হলে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আদিবাসীরা তাদের মাতৃভাষা হারাবে। হারাবে নিজস্ব স্বকীয়তা, পরিচিতি আর সাংবিধানিক লড়াইয়ের সুযোগ।

এজন্য আদিবাসীদের ভাষা টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি নিজেদের গুরুত্ব দেয়া।
আমাদের দেশের আদিবাসীদের শিক্ষার হার এখনও কম। তাদের এত কম শিক্ষার হার হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, দুর্গম এলাকা, অসচেতনতা, অনিরাপত্তার পাশাপাশি মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ না থাকাও একটি অন্যতম কারণ।
মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ আদিবাসীদের প্রাপ্য অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আন্তর্জাতিক আইনগুলোতেও আদিবাসীদের মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র ২০০৭-এ মাতৃভাষা সম্পর্কে ১৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা প্রদানের জন্য তাদের সাংস্কৃতিক রীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পাঠদান ও শিক্ষণ পদ্ধতি অনুসারে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং তাদের নিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে।’ আরো বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে যৌথভাবে, যারা তাদের সম্প্রদায়ের বাইরে বসবাস করছে তাদেরসহ আদিবাসী মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের জন্য, সম্ভব ক্ষেত্রে, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’
কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ভাষা শিক্ষা লাভের কয়েকটি সমস্যা প্রকট। সংবিধানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট অর্ন্তভুক্তকরণ, সুষ্পষ্ট রুপরেখা নিজস্ব লিপিতে বর্ণমালা না থাকা, আদিবাসী ভাষায় বই রচনাসহ আদিবাসী শিক্ষকদের এখনো নিয়োগ না দেওয়ার কারনে দিন দিন আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণ অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। আদিবাসী ভাষা, গানে, সংস্কৃতিতে যে অপিরেময় ও সম্ভাবনাময় রুপ-রস, জীবনের গভীর তরঙ্গ রয়েছে তা এই প্রজন্মের আদিবাসীদের নতুন করে আবিস্কার করতে হবে। আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির মহাকাব্য নির্মাণ, অনুশীলন ও সংরক্ষনের মত কঠিন কাজগুলোকে বাস্তবায়ন করতে আদিবাসী তরুন প্রজন্মকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এই জাতিগোষ্ঠীর এখন তরুন-তরুনী উচ্চ শিক্ষিত। শিক্ষিত হয়ে জীবনের তাগিদে অনেকেই ভুলে যান নিজের জাতিগত নৈতিকতা-দায়-দায়িত্বের বিষয়টা। এটা করলে চলবে কেন? তবে মোদ্দা কথা, আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষনে সরকারের বন্ধুসূলভ সর্বাত্বক সহযোগীতা অব্যাহত রাখাটা অত্যন্ত জরুরী।

এছাড়া আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন-১৯৫৭ (১০৭)-এর ২৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আদিবাসী ছেলেমেয়েদের তাদের মাতৃভাষা পড়তে ও লিখতে শিক্ষাদান করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে এ সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে। তবে প্রশংসনীয় যে, আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ এসব আদিবাসী ছেলেমেয়েদের তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা শিক্ষা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ রয়েছে। যদিও এটি মাতৃভাষা শিক্ষা না হয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা হলে আরও ভালো শোনা যেত। সে পথ ধরেই, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে অন্তত ৫টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর শিশুদেও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার ঘোষণা আসে সরকারিভাবে। সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই কিন্তু সকল আদিবাসী শিশুদের হাতে মাতৃভাষার বই ঠিকমতো না পৌঁছানো, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, স্ব-স্ব ভাষায় শিক্ষা দেয়ার জন্য ওই জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষাজ্ঞান থাকা শিক্ষকের নিয়োগ না দেওয়ার কারণে এখনও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কার্যক্রমটি শতভাগ সফল হয়ে ওঠেনি। আর মাত্র ৫টি আদিবাসী জাতিসত্তার মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য যে ভাষাগুলো রয়েছে তাদের জন্যও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে আদিবাসীদের জন্য কমপক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষায়-শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেয়া উচিত। এ লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় লবি ও ক্যাম্পেইন জোরদার করা উচিত। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ভাষা, রীতি, প্রথা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা, ঐতিহাসিক নিদর্শন ইত্যাদি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন তথা বহুমাত্রিক সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে পৃষ্ঠপোষকতা জোরদার করা উচিত।

লেখক: কালিদাস রায়, সাংবাদিক ও জাতীয় আদিবাসি পরিষদ, নাটোর শাখার সাধারণ সম্পাদক

Previous article`বিষন্ন প্রহর’ রেজাউল করিম রেজার কবিতা
Next articleঅনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যত ম্যানুয়াল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here