
প্রতিবছর ঈদুল ফিতরকে ঘিরে চাঙ্গা হয় গ্রামীণ অর্থনীতি। ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষকের হাতে টাকা না থাকায় এবার ঈদ কেন্দ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে চলছে মন্দাভাব। ধান কাটার মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানান ধরনের মেলা হয়। এবার এসব গ্রামীণ মেলাও তেমন বসেনি। ধানের দরপতনের প্রভাব পড়েছে ঈদবাজারেও। ঈদে জমেনি গ্রামীণ বাজারে কেনাকাটা। এর মধ্যেই অনেক কৃষক পানির দামে ধান বেচে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করেছেন। অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে গরু-ছাগল বিক্রি করছেন।
এ বছর ধানের দাম কম থাকায় রমজান শেষ হতে চললেও সারাদেশে জমেনি ঈদের বাজার। কৃষক পরিবার গুলোতে নেই ঈদ আনন্দ। বোরো মৌসুমের শুরুতে কৃষকরা বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও ও গ্রামীণ সমিতি থেকে ঋণ করে চাষাবাদ করেন। মৌসুম শেষে ফসল বিক্রি তারা ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু এ বছর ধানের দাম কম, ফসলের ফলন কম হওয়ায় ও ফসলের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচের টাকাও ঘরে তুলতে কৃষককে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে দেশের কৃষকদের মধ্যে নেমে এসেছে চরম হতাশা। সব মিলিয়ে এ বছর কৃষকদের ঈদের বাজারে নেই আগ্রহ।
কৃষিশুমারি অনুযায়ী দেশে ১ কোটি ৪৫ লাখ কৃষকের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড রয়েছে। সরকার ২ কোটি ৮৬ লাখ কৃষকের ডাটাবেজ তৈরি করেছে। এর মধ্যে এক কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক আছেন। সাধারণত তারা উৎপাদিত ধানের অর্ধেকের বেশি বিক্রি করে ঋণ শোধ ও পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেন। ধানের দরপতনে ওই এক কোটি ক্ষুদ্র কৃষক ও তাদের পরিবারের পাঁচ কোটি সদস্য এখন হতাশায় ভুগছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষকের মনে আনন্দ নেই। সে কারণে এবার তাঁদের পরিবারেও ‘ঈদ’ নেই। হাতে টাকা না থাকায় এসব পরিবারের সদস্যরা কেনাকাটা করতে পারছেন না। এ বছর ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। এবার কৃষকরা বিঘাপ্রতি প্রায় ১০/১২ হাজার টাকা খরচ করে ফলন পেয়েছেন ১৮/২০ মণ ধান। বাজারে ধানের দাম না থাকায় কৃষকদের বিঘাপ্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে দু’আড়াই হাজার টাকা। ধান বিক্রি করে সার, তেল, কীটনাশকসহ শ্রমিক মজুরির দাম ওঠাতেই হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা। এমন অবস্থা বিরাজ করলে আগামীতে ধান চাষে বিমুখ হবেন সাধারণ কৃষকরা। সরকারিভাবে প্রতি মণ ধানের বিক্রয় মূল্য এক হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৭০০-৭৫০ টাকা দরে। সরকারি গুদামে চাল দিতে চালকল মালিকরাও বাজারে ধান ক্রয় শুরু করেননি। ফলে ধানের বাজারে আসছে না কাঙ্খিত পরিবর্তন। আসন্ন ঈদ উৎসবে পরিবারের চাহিদা মেটাতে অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে পানির দামে তাদের কষ্টে অর্জিত সোনার ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিছু কিছু কৃষক সরকারি মূল্যে ধান বিক্রি করতে ছুটছেন জনপ্রতিনিধি থেকে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের দুয়ারে দুয়ারে। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যেসব কৃষকের জমি ৫০ শতাংশের নিচে। এমন কার্ডধারী কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান বিক্রির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে কৃষি বিভাগ বা ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অন্যথায় এ সুযোগ পাবেন না কৃষকরা। তবে কৃষকরা বলছেন, কয়েক বছর আগে কৃষি বিভাগ কৃষকদের ভর্তুকির বীজ সারের জন্য কৃষিকার্ড করে দেন। সেই সময় কার্ডে উল্লেখিত জমির পরিমাণ অনুযায়ী কৃষক সার ক্রয় করতে পারতেন। তাই সারের চাহিদা মেটাতে কম জমির বর্গা চাষিরাও অধিক সংখ্যক জমি দেখিয়ে কার্ড করেছেন। ফলে আয়তনের চেয়েও কৃষকের জমির পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। ইচ্ছামত জমি দেখিয়ে কৃষক কার্ড করা বর্গাচাষিরাও পড়েছেন অনেকটা বিপদে। ঋণ করে অল্প জমিতে ধান করেও কার্ডে ভূলের কারণে তারা ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারছেন না। এছাড়াও অনেকেই ধান চাষ না করেও তাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে ধান বিক্রির খাতায়। ফলে প্রকৃত চাষিরা বঞ্চিত হয়েছেন।
হাওর অঞ্চলেও ঈদ আনন্দ নেই। হাওরের দোকানগুলোতে বেচা-বিক্রি কম। ধান বিক্রি করেই হাওরের বিশাল জনগোষ্ঠী ঈদুল ফিতরের কেনাকাটা করেন। কিন্তু এবারে ধানের বাজার নিম্নমুখী। লোকসান দিয়ে এক মণ ধান বিক্রি করেও ঘরের গৃহিণীর জন্য একটি পছন্দের শাড়ি কিনতে পারছেন না। কৃষি নির্ভর এলাকাগুলোতে এখনও ক্রেতা শূন্য দোকান।
কৃষকের এ ক্লান্তিকালে দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদ। ঈদ আনন্দে ভাসছে পুরো দেশ। শ্রমজীবী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সবাই কমবেশি সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত। শুধু ঈদ আনন্দ নেই প্রায় ১ কোটি ক্ষুদ্র কৃষকের ঘরে। কেনা হয়নি নতুন জামাকাপড়। ধানের কম দামে কৃষক পরিবারের বাচ্চাদের ঈদ আনন্দ ¯øান হয়ে গেছে।
সব মিলিয়ে এ বছর কৃষকদের ঈদের বাজারে নেই আগ্রহ। তবে ধানের মূল্য না থাকায় কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন অবস্থা বিরাজ করলে আগামীতে ধান চাষে কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন।
লেখক: আবু জাফর সিদ্দিকী
