
মাহবুব হোসেন:
নাটোরের সিংড়া উপজেলার রামানন্দ খাজুরা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থাঔল। এই গ্রামের গ্রাম্য প্রধান ইউসুফ আলী। তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত। তবে গ্রাম্য প্রধান হওয়ার সুবাদে গ্রামে তার বড় প্রভাব আছে। এই প্রভাবের সুযোগে ইউসুফ আলী নামে -বেনামে গ্রামের অন্তত সাতটি সরকারী খাস পুকুর দখল করেছেন। সবগুলোই তার নিয়ন্ত্রণে। তবে ইউসুফ আলী জনস্বার্থে ব্যবহার্য দেখিয়ে মামলা করে পুকুরগুলো দখল করলেও এখন আর সে পুকুরে গ্রামবাসীদের নামতে দেয় না।
ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, গ্রামবাসীর পক্ষে ইউসুফ আলী নামে-বেনামে গ্রামের সাতটি পুকুর সরকারি ইজারার বিপক্ষে মামলা করেছিলেন। এগুলোর খতিয়ানে মন্তব্য লেখা আছে, ‘জনস্বার্থে ব্যবহার্য, বন্দোবস্তের বহির্ভূত’।
পুকুরের পানি সেচ কাজে ব্যবহার দেখিয়ে নাটোরে দুই শতাধিক খাস পুকুর দখল!
জাহাঙ্গীর বলেন, আদালত স্থিতাবস্থা জারি করার পর ইউসুফ এখন এগুলোতে বেআইনিভাবে মাছচাষ করছেন। তিনি একাধিকবার রাজস্ব সভায় বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ইউসুফ আলী এ প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমি পুকুর লীজের বিষয়ে কিছু জানি না। কারা লীজ নিয়েছে তাও জানি না। আর আমি কোন পুকুর দখলও করিনি। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতেও পারব না।
আরএস রেকর্ডে ‘মন্তব্য’ কলামের অপব্যবহারে খাস পুকুর দখল!
তবে সরেজমিনে থাঔল গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চৌপুকুরিয়া মৌজার ২৪০৯ দাগের ১দশমকি ১৯একর, ১২৪৭দাগের শূণ্য দশমিক ৯৩একর, ৯৫৬দাগের ১দশমকি ৬০একর সহ আশ-পাশের অন্তত সাতটি সরকারী খাস পুকুর জনস্বার্থে ব্যবহার্য দেখিয়ে সরকারের বিপক্ষে মামলা করেছেন। মামলায় আদালত স্থিতিবস্থা জারি করার পর, সে পুকুরগুলো এখন নিজেই দখল করে মাছ চাষ করছে। অথচ স্থিতিবস্থা পুকুরে মাছ চাষ করার কোন বিধান নেই।
থাঔল গ্রামবাসী অন্তত ১০ জন বলেছেন, আগে তাঁরা পুকুরগুলো নানা কাজে ব্যবহার করতেন। এখন সেগুলোতে নিয়মিত মাছ চাষ হচ্ছে। তাঁরা শুনেছেন, ইউসুফ আলীই খামারগুলো কওে বছওে ১৫-২০ লাখ টাকা আয় করছেন। তিনি কাউকে পুকুরে নামতে দেন না। বাড়ি-ঘর পুকুওে ভেঙ্গে গেলেও মাটি কাটতে দেন না। তাঁর কথার কেউ প্রতিবাদ করলে, সমজাচুত্য করার ভয় দেখান।
নেতারা সব ভাইভাই:
একই উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়ন যুবলীগের এক নেতা। ইউনিয়নের নিমাকদমার গ্রামের তিনটি খাসপুকুর দখল করে তিনি। আনোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে মামলা করার পর গত পাঁচ বছর ধরে মাছ চাষ করে যাচ্ছেন বলে এলাকার মানুষজন বলেছেন।
ওই যুবলীগ নেতা বলেন, ‘সরকারী কোন পুকুর দিঘি আমি দখল করিনি। আমি লীজ নিয়েই মাছ চাষ করি। যারা দখল করার কথা বলছে, তারা আমার প্রতিপক্ষ। বিরোধিতার কারনে তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে।’
কাগজপত্র আর মানুষের অভিযোগ অনুযায়ী, জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও সিংড়া উপজেলার খাজুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার বৃকয়া, মুচরগারা, সিয়ানপুকুর, রানীপাড়া, দিঘিরপাড়া এবং পাইকপৌরি পুকুরগুলো একাই নিয়ন্ত্রণ করে।
তপন কুমার বলেন, ‘পুকুর ইজারার বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। আর আমি কোন পুকুর নিয়ন্ত্রণও করিনা। তবে শোড়াইর, বালাল দিঘি গ্রামবাসীরা স্থানীয় মসজিদ, মাদ্রাসা এবং মন্দিরের নামে লীজ দিয়েছে। আমি এর সাথে জড়িত নই।
এছাড়া, চৌগ্রাম, ডাহিয়া, ইটালী, সুকাশ ইউনিয়নের বেশির ভাগ সরকারী খাস পুকুর নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা। তবে কিছু কিছু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সরকারী খাস পুকুর দখল করার অভিযোগও রয়েছে। এবিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন জানার পরও কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা জানান, তৎকালীন সিংড়া উপজেলার ইউএনও সুশান্ত কুমার মাহাতো অর্থিক সুবিধা নিয়ে নামে-বেনামে সরকারী পুকুর দখলে সুযোগ করে দিয়েছেন। তার সময়ে ১০৪টি পুকুর ইজারা প্রদানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যার কারনে সরকার বড় ধরনের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
সিংড়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার এমএম সামিরুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা সরকারী খাস পুকুরগুলো কি অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোর তালিকা করছি। তবে যতদুর জানা সম্ভব হয়েছে, ১২৬টি পুকুরের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এরমধ্যে সম্প্রতি ১০টি পুকুরে সরকারের পক্ষে রায় এসেছে। বাঁকিগুলো আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া ১০১টি পুকুর ভরাট দেখানো হয়েছে, যেগুলোতে ভরাট হওয়ার কারনে কোন মাছ চাষ হচ্ছে না। অথচ আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সেগুলোতেও মাছ চাষ হচ্ছে।
নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল ইসলাম বলেন, সরকার পক্ষ আদালতে মামলাগুলোর জবাব দিয়েছে। স্থিতিবস্থা জারি হওয়া পুকুরগুলো লিজ দেওয়ার কথা তাঁরা শুনেছেন। আইনে এর কোনো সুযোগ নেই। তবে এসব লিজের কোনো কাগজপত্র না থাকায় প্রশাসন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
আগামীকাল পড়ুন: বিশেষজ্ঞদের মতামত: জনস্বার্থ রক্ষা না পাওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে সরকারের।
