
গুজব লঘুপক্ষসঞ্চারী মেঘের মতো ভেসে বেড়ায় না, বরং বাতাসের আগে সংশয়ী মনের বাতায়ন দিয়ে প্রবেশ করে সবকিছু গুবলেট পাকিয়ে দেয়। তখন সেই তালগোল পাকানো মন কান ছিনিয়ে নেওয়া চিলের পেছন ছুটতে থাকে, দিগ্বিদিক জ্ঞান লোপ পায় তার। এই লক্ষণায় দ্রুত আশপাশের লোকও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই গুজব নিয়ে এত ভয়, এত শঙ্কা। ফারসি ‘গুজাফ’ শব্দটি বাংলায় ঢুকে ‘গুজব’ রূপ নিয়েছে। যার অর্থ রটনা, জনশ্রুতি, জনরব ইত্যাদি। অর্থাৎ গুজব ধারণাটির সঙ্গে জনতার একটি সম্পর্ক আছে। গুজব একা কারও ভেতর থাকলে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে না। তার প্রয়োজন হয় একপাল মানুষের, যারা চোখকান বন্ধ করে যেকোনও রটনা বিশ্বাস করে ফেলবে। মানে মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করে ফেলবে, সামষ্টিকভাবে, এরপর কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগ ব্যতিরেকে সক্রিয় হয়ে উঠবে।
সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানানোর এমন ছেলেখেলা কিংবা আগুনখেলা চলার সময় অনেকেই আবার গুজবের কারখানা আবিষ্কারে রত হয়েছেন। কিন্তু এই আবিষ্কারকরা খোঁজ নিচ্ছেন না মশার কারখানা কোথায়? আর ডেঙ্গুর কারণে ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেওয়া কারখানাগুলোর বিরুদ্ধেও যে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি, সেটাও তাদের গুরুত্বের তালিকা স্থান পাচ্ছে না। সুযোগে হাসপাতালগুলোও অযৌক্তিকভাবে পয়সা বানিয়ে নিচ্ছে! তাহলে মানুষ একদিকে মশার কামড়ে মরছে, অন্যদিকে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এরাও এক ধরনের মশাই, মানুষের পকেট থেকে পয়সা শুষে নিচ্ছে। এই দুই ধরনের শোষককেই নির্মূল করতে হবে। যদিও সরকারের তরফ থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফি পাঁচশ’ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেটা পালন করা হবে কিনা, তা একটা বড় প্রশ্ন। এর আগে নানা সময়ে জিনিসপত্রের দামও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো মানা হয়নি।
প্রায় সময়েই সত্যকে গুজব বলে অথবা অন্যকিছু দিয়ে চাপা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। রাষ্ট্রে এমন সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার কারণেই আসলে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছে মানুষ। এ কারণেই তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। কারণ তারা জানে, দিনকে রাত অথবা রাতকে দিন বানিয়ে দেওয়া এদেশে কোনও ব্যাপারই নয়। এ কারণে ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে চটজলদি বিচারকাজ নিজেরাই করে ফেলতে চায় জনগণ। সাধারণ ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে নিরীহ প্রতিবন্ধীও তাই গণপিটুনি থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
একটা বিষয় ভেবে দেখা দরকার, কেন এই সমাজে গুজব এত কার্যকরী? বা কেন গুজবে মানুষ এত মেতে ওঠে? গুজবকে যদি আপনি স্ফুলিঙ্গ ধরেন, তো বারুদ হলো জনগণের মন। তাদের মন কেন বারুদে পরিণত হলো? সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ যারা দেখেছেন, তারা জানেন, ছবিটির ভেতর নানাভাবে বঞ্চনার শিকার সিদ্ধার্থ পথে এক চোরকে পেটানো হচ্ছে দেখে, সেখানে দৌড়ে গিয়ে দুই একটা ঘুষি দিয়ে ফিরে আসে। যেন তার বঞ্চনার শোধ সে অচেনা এক চোরকে পিটিয়ে নিতে চাইল। সমাজে যখন শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য ও খর্বিত স্বাধীনতা থাকে, তখন মানুষের মন বারুদে পরিণত হয় এবং এমন পরিস্থিতিতে গুজবের মতো আপাত নখদন্তহীন বাজে জিনিসও আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। কাজেই আবেদন থাকবে গুজব বন্ধ করতে সচেষ্ট হোন, দয়া করে গুজব নিয়ে উল্টো খেলা খেলবেন না, তাতে মানুষের মনে আরো বেশি করে দাহ্য পদার্থ জমা হবে।
