
বিশেষ প্রতিবেদক:
নাটোর জেলা কারাগারে জেল সুপার হিসেবে ২০১৭সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী যোগদান করেন আব্দুল বারেক। তার যোগদানের হিসাব অনুযায়ী তিনি দীর্ঘ চার বছর ধরে জেল খানায় সুপার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তবে জেল সুপার আব্দুল বারেক নাটোর জেলা কারাগারে যোগদানের পর থেকেই তিনি কারাগারকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেন। কারাগারের খাবার সরবরাহ, পোশাক, হাসপাতালের শষ্যা, দর্শনাথীর বিনিময়ে টাকা এমন কোন উৎস নাই যেখান থেকে তার পকেটে টাকা ঢুকেনি। পুরো কারাগারকে তিনি দুর্নীতির আতঁর ঘর বানিয়ে ফেলেন। সজাগ নিউজের অনুসন্ধানের জেল সুপার আব্দুল বারেকের দুর্ণীতির চিত্র একের পর এক বেরিয়ে আসছে। এমন কোন সেক্টর নাই, যেখানে আব্দুল বারেক অনিয়ম আর দুর্নীতি করেননি।আব্দুল বারেকের দুর্নীতির চিত্র সজাগ নিউজের পাঠকের সামনে তুলে ধরা হল।
বন্দিদের নিয়ে বাণিজ্য:
কারাবন্দিদের সাথে তাদের স্বজনরা দেখা করতে গেলেই লাগে টাকা। কথা বলতে গেলেও লাগে টাকা। আরামে খেতে এবং ঘুমাতে গেলেও লাগে টাকা। সম্প্রতি নাটোর জেলা কারাগার এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করতে গেলে কারাবন্দী, বন্দীর স্বজন ও কারাগার সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে পাওয়া যায় এসব চিত্র।
জানা যায়, একজন হাজতি কারা গেট থেকে প্রবেশের পর থেকেই শুরু হয় কারা কর্তৃপক্ষের কতিপয় কর্মকর্তার অর্থ আদায়ের সূচনা। এরপর জামিনে বের হওয়া পর্যন্ত হাজতিদের নিয়ে চলে তাদের অর্থ বাণিজ্য। যার ফলে কারা কর্তৃপক্ষ সব সময়ই সংবাদকর্মীদের এড়িয়ে চলেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করেন।
হাজতিদের কারাগারে প্রবেশের আগে তাদের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করেন কারাগারের কতিপয় কর্মকর্তা। ওই খাতার নাম হলো ‘পিসি বই’। হাজতি মুখে তার পরিচয় সঠিক বললেও লেখার সময় অনেকটাই ইচ্ছে করে পিসি বইতে ভুল তথ্য লেখা হয়ে থাকে। একজন হাজতির নাম যদি হয় ‘মিজানুর রহমান’ কারা কর্তৃপক্ষ তার নাম লিখবে ‘মিজানুর বহমান’। আদালত থেকে তার জামিন মঞ্জুর হলেও ‘র’ ও ‘ব’ এর বেড়াজালে আটকে দেয়া হয় ওই হাজতিকে। গেটের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীকে পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা দিলেই ‘ব’ আবার ‘র’ হয়ে যায়। কেউ টাকা দিতে না পারলে জামিন আদেশের পরও তাকে কমপক্ষে একদিন অতিরিক্ত জেলহাজতে থাকতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারে কোন বন্দির সাথে তার স্বাজনরা একটু নিরিবিলি দেখা করতে চাইলে এজন্য অফিস কলের নামে দিতে হয় এক হাজার টাকা, ঘরের জানালা কলের নামে ৫০০টাকা,সাধারণ কলে ১০০টাকা এবং গণহার কলে ১০টাকা করে দিতে হয়। এক্ষেত্রে পুরো টাকাই পকেটে যায় জেল সুপার আব্দুল বারেকের পকেটে।
হাজতি বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসা আব্দুর রহমান জানান, আমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেখানে সিরিয়ালের অজুহাতে প্রায় তিন ঘণ্টা বসে থেকেও দেখা করতে পারিনি। যখন এক কারা সদস্যকে তিনশ’ টাকা দিলাম, সে সঙ্গে সঙ্গেই দেখা করিয়ে দিল। তিনি আরও বলেন, এমন দৃশ্য যে কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই প্রতিনিয়ত দেখতে পারবেন।
কারা হাসপাতালের শষ্যা বাণিজ্য:
কারাগারের সবচেয়ে বেশি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে হাসপাতালে। কারাবিধি অনুযায়ী যে রোগী আগে যাবেন তিনি মেডিক্যালে সিট পাবেন। কিন্তু সেখানে চলে এর উল্টো। টাকার বিনিময়ে সুস্থদের সিট পাইয়ে দেয়া হয়। আর প্রকৃত অসুস্থরা থাকেন মেঝেতে। তবে কারা পরিদর্শক দল পরিদর্শনে গেলে অসুস্থদের বেডে রাখা হয়।কিন্তু তারা চলে গেলে পূর্বের নিয়ম চালু হয়।
সূত্র জানায়, কারা হাসপাতালের বেড়ে ১৫ দিন থাকার জন্য ৩হাজার টাকা এবং এক মাস থাকার জন্য ৭ হাজার টাকা দিতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক হাজতি জানান,যে কেউ দিব্যি সুস্থ হয়েও অসুস্থতার সার্টিফিকেট নিয়ে জেল কারাগারে গিয়ে ভর্তি হন।এতে করে সাধারণ বন্দিদের থেকে আরাম আয়েশে হাসপাতালের বেডে থাকা যায়।
প্রতিবেশীর এক মিথ্যা মামলায় ফেঁসে ২৭ দিন জেল খেটে জামিনে বের হয়েছেন আসিফ (ছদ্মনাম)। জানালেন জেলখানার নানা অনিয়মের কথা। আসিফ জানান, তিনি সুস্থ থাকলেও টাকার বিনিময়ে কারাগারের হাসপাতালে ছিলেন। কিন্তু সত্যিকারের যেসব অসুস্থ কয়েদি-হাজতি রয়েছেন তারা ঘুষ দিতে পারেন না বলে হাসপাতালের সিটের সুযোগ-সুবিধা পান না।
আরো পড়ুন: নাটোর জেল সুপারের রমরমা ক্যান্টিন বাণিজ্য
ক্যান্টিন ব্যবসা:
জেল সুপার আব্দুল বারেক নাটোর জেলা কারাগারে যোগদানের পর থেকেই তিনি ক্যান্টিন ব্যবসায় জোর দেন। তিনি যেখানেই যান, সেখানেই তিনি ক্যান্টিন ব্যবসা জমজমাট করে তুলেন। এজন্য তার নামও পড়েছে ‘ক্যান্টিন বারেক’।
বন্দিদের অভিযোগ, ক্যান্টিন থেকে বিক্রি হওয়া প্রায় সব ধরনের খাবারের দামই দ্বিগুণ। কারণ একটাই, সরকারি বরাদ্দের খাবারের মান ভালো নয়। তাই বাধ্য হয়ে বন্দীরা তাদের পিসিতে (অ্যাকাউন্ট) জমে থাকা টাকা দিয়ে কারা ক্যান্টিন থেকে খাবার গ্রহণ করছেন। এর মধ্যে ডিম ভাজি ৩০ টাকা আর রান্না ডিম নাকি ৫০ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাবারের মধ্যে কোনো কোনোটির দাম তিনগুণও আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে স্পিড ক্যান ৫০ টাকা আর সবজি এক কেজির দাম ৮০ টাকা।
তারা (হাজতি) আরও জানান, আমদানিতে একদিন রাখার পর হাজতিদের অপরাধ অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানেও টাকা। অনেক অপরাধী এক জায়গায় বসবাস করায় প্রায়ই হাজতিতের মধ্যে মারামারি বাধে। মারামারি করার অপরাধে তাদের কেস টেবিলে (কারাগারের বিশেষ বিচার ব্যবস্থা) হাজির করা হয়। তবে কারাগারের কতিপয় অসাধু সুবেদার, জমাদার ও সিআইডিদের টাকা দিলে পার পেয়ে যায় প্রকৃত অপরাধী। এর প্রেক্ষিতে উল্টো শাস্তি পেতে হয় নিরাপরাধীকে। ফলে কারাগারে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরাধ প্রবণতা। এছাড়া একটু ভালভাবে গোসল করার জন্যও টাকা গুনতে হয় কারাগারের বন্দীদের।
কারাগারের অভ্যন্তরে নগদ টাকা বহন করা বড় ধরনের অপরাধ। তাই বাইরে থেকে কেউ টাকা দিতে চাইলে ব্যাংক হিসেবে ন্যায় পিসি বইতে টাকা জমা হয়। কারো টাকার প্রয়োজন হলে পিসি বইয়ের মাধ্যমে ক্যান্টিন থেকে লেনদেন করা হয়ে থাকে। আর এখানেই হলো আসল দুর্নীতি। কেউ ১০০ টাকা চাইলে তাকে দেয়া হয় ৯০ টাকা। বাকি ১০ টাকা কমিশন বাবদ কেটে রাখা হয়। যদিও টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে জেলার বলেছেন, এ ১০ টাকা পিসি বই তৈরি করার জন্য নেয়া হয়।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন কারারক্ষী জানান, প্রতিমাসে জেলা প্রশাসক একবার কারাগার পরিদর্শনে যান। যে দিন জেলা প্রশাসক কারাগার পরিদর্শনে আসবেন তার আগের দিন কয়েদি-হাজতিদের কোনও রকম অভিযোগ যেন জেলা প্রশাসককে না জানানো হয়, তার জন্য হুঁশিয়ারি করা হয়। কারা অভ্যন্তরে পরিপাটি করে সাজানো হয় যেন জেলা প্রশাসক কোনও অনিয়ম না দেখেন। কেউ কোন অভিযোগ করলেই নেমে আসে নির্যাতন ।
একাধিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোর কারাগারের জেল সুপার আব্দুল বারেক বলেন, অসুস্থ হাজতিদের কারাগারের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়, কোনও সুস্থ হাজতিকে নয়। সুস্থ হাজতি টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে থেকে সেবা নিয়েছেন এমন অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি।
বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, আমার কারাগারে কোথায় খারাপ অবস্থা দেখলেন? যদি আপনি দেখা করতেন তাহলে আমি আপনাকে নিয়ে যেতাম। কারণ, জেল সুপার হিসেবে আমি সব অনৈতিক কাজ থেকে শতভাগ মুক্ত আছি। যারা অনিয়ম করছে তাদের কাউকে আমি ছাড় দিচ্ছি না।
জেল সুপার আরও বলেন, দর্শনার্থীদের জন্য কারা কর্তৃপক্ষের টোকেন ছাপানো হয়। দর্শনার্থীরা হাজতে থাকা স্বজনদের বিনা পয়সায় দেখতে পারেন। টাকার বিনিময়ে কয়েদিদের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেখানো হয় এটি মিথ্যা অভিযোগ। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগগুলো জেলা প্রশাসকের কাছে প্রকাশে কয়েদি ও হাজতিদের বাধা প্রদানের বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন।
