
নিঃসঙ্গ লোকটি যখন চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালেন তখন সূর্যের সমস্ত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে বায়ুমণ্ডলে। সাত-সকালে এমন উত্তাপে তিনি বেশ হাপিয়ে ওঠেন। তার সাদা পাঞ্জাবী শরীরের সাথে মিশে ভিজে একাকার হয়ে যায় এবং তা থেকে ঝাঁঝালো বিশ্রি দুর্গন্ধ অসহনীয় করে তোলে তাকে।
নিঃসঙ্গ লোকটি এদিক-ওদিক তাকিয়ে পিচঢালা রাস্তা পার হবার জন্য পা বাড়িয়ে দু কিম্বা তিনধাপ এগুতেই দেখলেন একটা মালবোঝাই ট্রাক তার দিকেই ধেয়ে আসছে। এমন সময় হঠাৎ তার মনে হল রাস্তায় বৃক্ষের মতো সটান দাঁড়িয়ে থাকতে। ট্রাকটি নিকটবর্তী হতেই তিনি দৌড়ে বাকি পথটুকু অতিক্রম করলেন। তারপর আনমনে কি যেন ভেবে তিনি চা-স্টলের দিকে হাঁটা ধরলেন।
স্টলের সামনে গিয়ে তিনি তার মতই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে অন্যান্য দিনের চাইতে কিছুটা বেশী কড়া লিকারের চা অর্ডার করে চিন্তিত মনে দাঁড়িয়ে রইলেন। এমন সময় হঠাৎ সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে তার সহধর্মিনীর মুখখানা মনে পড়ে যায় ভীষণভাবে। রহিমা বিবি যে কি না গত বছর জরায়ু ক্যান্সারে গত হয়েছেনÑ সেই নারীটির কথা মনে হতেই এক তীব্র অস্বস্তি নিঃসঙ্গ লোকটিকে আরো নিঃসঙ্গতায় নিমজ্জিত করল।
চা শেষ করে তিনি বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন। আজ কেন যেন তার বাড়ি ফেরার বহু পরিচিত পথটাকেই অচেনা লাগছে। বাড়ির উঠোন অব্দি না পৌছাতেই তার মনে হল চায়ের টাকা দেওনা হয়নি। আনমনে সে ভাবল পুণরায় গিয়ে চায়ের দাম পরিশোধ করে আসবে। কিন্তু মুহুর্তেই তার মনে হল তা আর সম্ভব নয়- কারণ ততক্ষণে কা¬ন্তিরা বেশ জেঁকে বসেছে তার পুরো শরীরে, মনে। ক্লান্ত শরীরটা টেনে-হিঁচড়ে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে নিঃসঙ্গ লোকটি টান হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।
নিঃসঙ্গ লোকটি নিঃসঙ্গ ছিলেন না। রহিমা বিবি মারা যাবার আগমুহূর্তে তার সংসার ছিল হাসি-আনন্দে ভরপুর। রহিমা বিবি ছিলেন সংসারী মানুষ। সারাক্ষণ স্বামীর পরিচর্যায় তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। স্বামীর একটু অযতœ- অবহেলা তার সহ্য হত না। নিঃসঙ্গ লোকটির বাবা ছিল খুবই সৌখিন মানুষ। ছেলেকে বিয়ে দিতে তিনি অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছিল। বিশ-ত্রিশটা কন্যা দেখার পরই তার রহিমা নামের কিশোরীকে পছন্দ হয়েছিল। বাবা মারা যাবার পর নিঃসঙ্গ লোকটি মনে-মনে বাবার পছন্দের তারিফ করতেন। রহিমা বিবি শুধু সুন্দরীই ছিল না গুণবতীও ছিল।
আজ নিঃসঙ্গ লোকটির মনে পড়ছে ত্রিশ বছর আগের রহিমা বিবিকে। নিঃসঙ্গ লোকটি স্মৃতির দোলাচালে নিমজ্জিত হয়ে বার-বার ফিরে যাচ্ছেন অতীতে। যেখানে স্তুপাকারে সাজানো ছিল সুখের পসরা।
স্মৃতিতাড়িত হয়েও নিঃসঙ্গ লোকটি বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারছেন না। রহিমা বিবি নেইÑ কথাটি মনে পড়তেই তার দ’ুগন্ড বেয়ে ঝরে পড়ছে শ্রাবণের অঝোরধারা আর বুকের দমকা বাতাস বেড়–তে না পেরে বাড়িয়ে দিচ্ছে শ্বাসকষ্ট। নিঃসঙ্গ লোকটির অসহায়ত্ব দিগুণ গাঢ় হয়েছে যেদিন থেকে তিনি বুঝতে পেরেছেন এ সমাজ-সংসারে তার দেবার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আগে মেয়েরা তার গোসল করিয়ে এবং সেই সাথে কাপড়Ñচোপড় কেঁচে, ঘরদোর পরিস্কার করে দেওয়া সহ যাবতীয় খোঁজ-খবর রাখত। ছোট মেয়েটা ঘর উদাসী হলেও বড়টা ছিল হুবহু তার মায়ের মতন। দু’ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর পুত্র বধুদের অনাদর-অবহেলা তাকে অসহায়ত্বের শূণ্যকোঠায় নামিয়ে দেয়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ লোকটিকে কোন প্রকার তোয়াক্কা না করেই চারপুত্র একে-একে যখন আলাদা হয়ে যাচ্ছিল তখনই নিঃসঙ্গ লোকটি বুঝতে পেরেছিলেন তার সাধের ফুলবাগিচায় আচমকা টর্ণেডো আঘাত হেনেছে এবং তা শত চেষ্টা করেও থামানো যাবে না। তাই সে নিরবে-নিঃশব্দে সব চেয়ে-চেয়ে অবলোকন করেছেন। আর নীরবে-নিঃশব্দে দেখা ছাড়া তার আর কিইবা করার ছিল। জমিজমা যা ছিল তা তিনি সকলের নামে আনুপাতিক হারে আগেই বন্টন করে দিয়েছেন। নিঃসঙ্গ লোকটির অসহায়ত্বের একটি বড় কারণ এই জমি। কিছু জমি জমা যদি তার নিজের নামে থাকত তাহলে সে অবশ্যই ছেলেÑছেলেদেও বৌদের কাছে কিছুটা সেবা-যতœ পেতো। নিঃসঙ্গ লোকটির অধিক সরলতা তাকে আজ মৃত্যুর কাছাকাছি এনে দাঁড় করিয়েছে। লোকটি এতই সরল ছিল যে জীবনে কারো কাছে কোন প্রকার ধার দেনা করেন নি, কারো সাথে বিবাদ করেননি। কেউ তাকে ভুল করেও কপট বলতে পারবে না।
আজ চা খাবার দু’টাকার জন্য তাকে ছেলেদের কাছে ভিখিরিদের মত হাত পাততে হয়। তার ছেলের বৌ-রা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যভাবে তাকে এড়িয়ে চলে। কুকুর-বেড়ালদের মত খেতে দেয়। একদিন রাতে যখন নিঃসঙ্গ লোকটি অসুস্থতার কারণে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন তখন তার বড় ছেলের বৌকে তিনি বলতে শুনেছেন‘বুড়া মরে না কেন-মরলে তো আপদ বিদেয় হয়।’ সারারাত নিঃসঙ্গ লোকটি দু’ চোখের পাতা এক করতে পারেননিÑ শুধু অঝোরে কেঁদেছেন। পরদিন ছেলেদের কাছে চিকিৎসার টাকা চেয়ে কারো কাছে পাননি।
মুলত সেখান থেকে নিঃসঙ্গ লোকটির মৃত্যু চিন্তা শুরু। প্রথম পর্যায়ে তিনি ভেবেছেন গলায় ফাঁস দেবেন এবং তার ঘরেই। এতে ছেলে-ছেলের বৌদের প্রতি মধুর প্রতিশোধ নেয়া হবে। কিন্তু পরক্ষণেই কেন যেন তার এরুপ মৃত্যু পছন্দসই হল না। দ্বিতীয়বার তিনি ভেবেছেন বাস অথবা ট্রাকের তলায় মাথা দেবেন। একদম খন্ড-বিখন্ড হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে মাংসপিন্ড, মাথার মগজ। এবং সে পরিকল্পনা মাফিক তিনি চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েও থেকেছিলেন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে মৃত্যুর জন্য পর্যাপ্ত সাহস না থাকায় তিনি ফিরে এসেছিলেন।
কিন্তু মৃত্যুচিন্তা তার পিছু ছাড়েনি বরং মৃত্যু দ্বিগুণ উৎসাহে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ লোকটির চারপাশে মোহনীয় ইন্দ্রজাল বিছিয়ে তাকে নিত্য-নতুন মৃত্যু উপায় বাতলে দিচ্ছিল। শেষে নিঃসঙ্গ লোকটিকে ‘মৃত্যু’ যে উপায় বলে দেয় তা হলো‘ট্রেন’। ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু সহজÑ এ কথাটিই নিঃসঙ্গ লোকটির মননে-মগজে কিছুদিন যাবত নাড়া দিচ্ছিল। সময় সুযোগ মত এই স্বেচ্ছা মৃত্যুকে গ্রহণ করার মানসে বৃদ্ধ ভেতরে-ভেতরে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।
সংসারের প্রতি অতিমাত্রায় ক্ষোভ ক্রমশঃ তার স্বাভাবিক চিন্তা চেতনাকে নিয়ত অস্বাভাবিক করে তুলছিল। নিঃসঙ্গ লোকটি যন্ত্রণাময় জগৎ ছেড়ে মৃত্যুকে সাদর আমন্ত্রণ জানানোর জন্যই একদিন ঘর হতে বেড়িয়ে পড়লেন। অবশ্য বের হবার আগেই তিনি ভালো করে বাড়ির চারপাশ দেখে নিলেন। তারপর মাঠে গিয়ে জমির আলধরে হেঁটে গেলেন। জমির শেষ মাথায় গিয়ে কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটার নীচে গিয়ে বসলেন। তার মনে পড়ে গেল রহিমা বিবিকে। রহিমা বিবি বেঁচে থাকতে এই তালগাছটার ছায়ায় বসতেন। তারপর গলা ছেড়ে ডাক দিয়ে তাকে ডেকে এনে বাতাস করতেন। কত হাসি-ঠাট্টার সাক্ষী এই বর্ষীয়ান তালগাছ! হঠাৎ ভাবনার পরিবর্তন করে নিঃসঙ্গ লোকটি দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলেন। একটানা হেঁটে সে চা-স্টলে এসে তড়িঘড়ি করে বিগত দিনের চায়ের দাম পরিশোধ করে চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে, রিকসা ভাড়া করে রিকসাওয়ালাকে দ্রুত গন্তব্যে পৌছানোর তাগিদ দিতে থাকেন।
তখন রৌদ্রের উত্তাপ তেমন বাড়েনি। ফুরফুরে বাতাস নিঃসঙ্গ লোকটিকে কোন প্রকার স্বস্তি না দিয়ে দ্বিগুণ বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তিনি প্রবল মাত্রায় ত্যক্ত-বিরক্ত ছিলেন। বার কয়েক রিকসাওয়ালাকে ধমক দিলেন জোড়ে প্যাডেল চালানোর জন্য। রিকসাওয়ালা নিঃসঙ্গ লোকটির কথার তোয়াক্কা করছেন না দেখে বৃদ্ধের রাগ আরো চড়ে গেল। আর এই সুযোগে মৃত্যু চুপিসারে নিঃসঙ্গ লোকটিকে বলে গেল-‘এসো আমায় আলিঙ্গন করো, বিদায় জানাও পৃথিবীকে, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা ঝামেলা। মুক্তি পাবেনা কোথাওÑ মুক্তির একমাত্র নাম মৃত্যু।’
প্রায় সোয়া একঘন্টা পর গন্তব্য পৌছে নিঃসঙ্গ লোকটি পাঞ্জাবীর পকেট হাতড়ে টাকা বের করে রিকসা ভাড়া মিটিয়ে রিকসাওয়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন কর্কশ ভাষা ব্যবহারের জন্য।
তারপর নিঃসঙ্গ লোকটি পাশের স্টলে ঢুকে গেলেন নিঃশব্দে। কিছুক্ষণ বসে থেকে তিনি দোকানীর কাছ থেকে ট্রেন আসার সময় জেনে নিলেন । ট্রেন আসতে তখনো আধাঘন্টা বাকি। নিঃসঙ্গ লোকটি চা নিয়ে খুব আস্থির ভঙ্গিমায় চা শেষ করে সিগারেট ধরালেন। বহু পুরনো নেশাকে তিনি স্বাগত জানালেন সিগারেট ধরানোর মধ্য দিয়ে। খুব জোরছে দম দিয়ে তিনি সিগারেট শেষ করে ঝিম মেরে বসে থাকলেন। এই সময় তিনি অনুভব করলেন উত্তেজনায় তার ভেতর-বাহির কাঁপছে। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর তিনি বসা থেকে উঠে চা- সিগারেটের মুল্য পরিশোধ করে হাঁটতে থাকলেন রেললাইন ধরে। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেলের শব্দ পেয়ে সচকিত হয়ে নিঃসঙ্গ লোকটি কৃত্রিম উৎফুলতার সাথে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলেন ট্রেন আসছে। চলার বাঁক পরিবর্তন করে নিঃসঙ্গ লোকটি ট্রেন অভিমুখে দৌড়াতে থাকলেন। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়ছে…ক্রমাগত বাড়ছে… তার মনে পড়ছে ছেলেমেয়েদের কথা- ছেলের বৌদের কথা। শেষে তার মনে পড়ে গেল রহিমা বিবিকে। হঠাৎ সহধর্মিনীর আবয়ব বড় ক্যানভাসে ভেসে উঠলো নিঃসঙ্গ লোকটির সম্মুখে। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন স্ট্যাচুর মতো। চারপাশ প্রকম্পিত করে ট্রেন চলে গেল।
ট্রেন চলে যাবার পর দেখা গেল নিঃসঙ্গ লোকটি আকাশ দেখছে মগ্ন হয়ে। তাকে ঘিরে থাকা অসংখ্য মানুষদের কোন কথাতেই নিঃসঙ্গ লোকটি সচকিত নন…
লেখক: নাজমুল হাসান, কবি ও সাহিত্যিক
