
নাজমুল হাসান, বিশেষ প্রতিবেদক:
নাটোরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে রক্তচোষা সুদের কারবার। সুদ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে নিঃস্ব হচ্ছেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। সুদের কারণে ঘটেছে নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা। সুদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঘটে হামলা মারধরসহ জমি দখলের মতো ঘটনা।
সুদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ইতিমধ্যে সুদের করাল থাবা থেকে প্রতিকার চেয়ে পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী। সুদের কারবার বন্ধে কঠোর হবার কথা জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নাটোর শহরতলীর ‘হাজরা নাটোর’ এলাকায় সুদের ব্যবসা ভয়াবহ থাবা বিস্তার করেছে। রক্তচোষা এই কারবারের জন্য প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা। চড়া সুদে টাকা নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন। অনেকেই হয়েছেন নিঃস্ব। আর কেউবা হয়েছেন বাড়ি ছাড়া।
‘হাজরা নাটোর’ এলাকার কল্পনা পাহান জানান, হঠাৎ তার কিডনির সমস্যা হলে তিনি সুদ কারবারি খুশি বেগমের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এরপর কয়েক ধাপে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা পরিশোধ করেন তিনি। কিন্তু সুদ বাবদ খুশি বেগম তিন লাখ টাকা দাবী করেন। এরই এক পর্যায়ে একদিন দলবল নিয়ে বাড়িতে এসে ভয়ভীতি দেখিয়ে একটা ফাঁকা স্ট্যাম্পে তার স্বামী গোহনু পাহানের স্বাক্ষর নেয় তারা।
এর সপ্তাহ খানেক পরে তাদের দুই শতাংশ জমির উপর নির্মিত কাচা বাড়ি থেকে তাকে তাড়িয়ে দেন সুদ ব্যবসায়ী খুশি বেগম। এখন সেখানে পাকা দালান তুলে বসবাস করছেন খুশি। দলিল থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে জায়গার দখল নেই তার। অন্যের জমিতে কাজ করে কোনওভাবে বেঁচে আছেন তিনি। এ বিষয়ে কাউকে জানালে প্রাণে মেরে ফেরার হুমকিও দেন খুশি বেগম।
একই এলাকার সামছুন্নার জানান, সুদ ব্যবসায়ী খুশি বেগমের কাছ থেকে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছিলেন তিনি। পরে বসতবাড়ি বিক্রি করে চার লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছেন খুশিকে। কিন্তু আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবী করে সে। নানা সময়ে সন্ত্রাসী বাহিনি নিয়ে বাড়িতে এসে চড়াও হন সুদ কারবারি খুশি।
চোখের জল মুচতে মুছতে সামছুন্নার জানান, বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এখন তার সদয় হস্তক্ষেপের আশায় পথ চেয়ে আছি। এটার প্রতিকার না পেলে আমাদের ধুকে ধুকে মরা ছাড়া আর কোনও গতি নেই।
রহিমা বেগম নামে আরেকজন ভুক্তভোগী জানান, তার ছেলে ওমর ফারুক দুই বছর আগে দেড় লাখ টাকা সুদের উপর নেয়। পরে ওমর ফারুক সিঙ্গাপুর চলে যায়। প্রথম দিকে টাকা পাঠালেও করোনা ভাইরাসের কারণে তার ছেলে আর টাকা পাঠাতে পারেনা। পরে সুদের টাকার জন্য চাপ সৃষ্টি হলে নিরুপায় হয়ে বসতভিটা বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দেন সুদ কারবারি খুশি বেগমকে। তারপরেও আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবী করছেন খুশি। নানা সময়ে এই টাকার জন্য মারধর ও খুন করে ফেরার হুমকি দেয় খুশি।
সম্প্রতি একই এলাকার গোপাল মন্ডল সুদের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেন।
গোপাল মন্ডলের স্ত্রী তুলসী রানী মন্ডল জানান, গত জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে সুদ ব্যবসায়ী মিতা তাদের বাড়িতে এসে সুদের টাকা পরিশোধের জন্য অনেক গালাগালি করে। তাদের গাভি নিয়ে যেতে চায়। সেদিন রাতেই ক্ষোভে দুঃখে তার স্বামী গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে মারা যান। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে জীবনযাপন করলেও এখনো প্রতিনিয়িত সুদের টাকার চাপ সহ্য করতে হচ্ছে তাদের।
এ বিষয়ে খুশি বেগম জানায়, নানা সময় কেউ বিদেশ যাবি, তাকে ট্যাকা দিয়ে উপকার করি। কারো চিকিৎসা করা লাগবি, তখন টাকা দিয়্যা সাহায্য করি। কিন্তু ট্যাকা লেওয়ার পর আজ তিন বছর ধইর্যা কেউ-ই ট্যাকা দেয়না। ট্যাকার জন্য কাউকে মারধর বা হুমকি দেইনি। কল্পনা পাহানের জমি দখলের বিষয়ে তিনি জানান, আমি কল্পনার কাছ থিক্যা জমি কিন্যা লিছি। এখন পুরো এলাকার লোকজন মিল্যা ষড়যন্ত্র করিচ্ছে। আমাকে এলাকা ছাড়া করার চেষ্টা করিচ্ছে। রেজিষ্ট্রি না করে জমির মালিক হলেন কিভাবে এমন প্রশ্নের কোন সুদুত্তর দিতে পারেননি খুশি বেগম।
আরেক সুদ কারবারি মিতার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওনা যায়নি। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে মিতার স্বামী মানিক জানান, গোপাল ট্যাকা নিয়েছিল সত্যি। ট্যাকার জন্য গরু দিয়ে দিতে চেয়েছিল। তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়নি। বউয়ের সাথে ঝগড়ার কারণে গোপাল আত্মহত্যা করেছে। আপনার খোঁজ খবর নিলেই সত্যিটা বের করতে পারবেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, এক খুশি বেগম পুরো ‘হাজরা নাটোর’ গ্রামকে নরক বানিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগে অনেককে জিম্মি করেছে। খুশি বেগম সুদের কারবার করবে না বলে সদর থানায় মুচলেকা দিয়ে এসেছিল। তবুও তার অপতৎপরতা থামেনি। এছাড়াও আরেক সুদ ব্যবসায়ী মিতা রানীর কারণে গোপাল নামে এক যুবক আত্মহত্যা করেছে। সুদের আগ্রাসনে ‘হাজরা নাটোর’ এলাকার বেশ কয়েকজন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তাদের সাজানো গোছানো সংসার এলোমেলো হয়ে গেছে। সুদের কারবার বন্ধে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
নাটোর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, নাটোরে সুদের কারবার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানুষজন জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সুদ ব্যবসায়ীর হাত থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। যদি কেউ বিপদে পড়ে ১ লাখ টাকা সুদ নেয়, তাহলে ৫ লাখ টাকা দিয়েও সুদ ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ হয় না। সুদ ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের জমি পর্যন্ত জোরপূর্বক দখল করে নিচ্ছে। এই অবৈধ কারবারের ফলে এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট হচ্ছে। এরা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। দ্রæত এদের প্রতিরোধ করতে কার্যকরি প্রদক্ষেপ নেয়া দরকার।
জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ জানান, অসাধু সুদ কারবারিদের তালিকা তৈরি করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেই সাথে আদিবাসি কল্পনা পাহারের জমি দখলের বিষয়টি ইতিমধ্যে অবগত হয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রকৃত মালিককে জমিটি বুঝিয়ে দেয়া হবে।
পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, ইতিমধ্যে সুদ কারকারের করাল থাবায় জেলা জুড়ে নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। আমরা ‘হাজরা নাটোর’ এলাকার অনেকগুলো ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়েছি। ইতিমধ্যে সুদ কারবারিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগও পেয়েছি। সুদের কারবার যারা করে তাদের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এসব টাকা আদায়ের জন্য অনেকেই নিরিহ মানুষদের উপর জুলুম নির্যাতন করে। জমি বাড়িঘর দখল করে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়। এসব জুলুম ও নির্যাতনকারী সুদ ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয় হবে। যেন এলাকা থেকে সুদের কারবার পুরোপুরি নির্মূল হয়।
