
নাজমুল হাসান:
এ যেন সেই মান্ধাতার যুগে বসবাস। নাটোর শহরতলীর একটি গ্রামে চলছে পুরনো আমলের মতই মাতবরি প্রথা। যেখানে নেই আইনকানুনের বালাই। সেই গ্রামে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধও ধামাচাপা দেবার চেষ্টায় মেতে উঠেছে একদল গ্রাম্য মাতবররা।
ধর্ষনের ঘটনায় সপ্তাহ পার হলেও বিষয়টি আপস মিমাংসার কথা বলে টালবাহানা করে কৌশলে দিন পার করেছে গ্রাম্য মাতবররা। ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে মাতবরি প্রথার ভয়াবহ চিত্র।
অনুসন্ধানে নাটোরের গোয়ালডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পুরো গ্রামে কেমন যেন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। তথ্য ছিল, এই গ্রামের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী প্রতিবেশী এক যুবকের দ্বারা ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে। তা ধাপাচাপা দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে গ্রাম্য মাতবররা।
ঘটনা খতিয়ে দেখতে ভুক্তভোগির বাড়িতে যাবার পরও বাড়ির বাসিন্দারা সবাই গা ঢাকা দেয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে প্রতিবেশীদের মাধ্যমে ধর্ষণের স্বীকার মেয়েটির বাবা মাকে হাজির করা হয়। সাংবাদকর্মী আসার খবরেই সেখানে ছুটে আসেন খোরশেদ আলম নামে গ্রাম্য মাতবরদের একজন।
কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি চড়া গলায় বলেন, এখানে ধর্ষনের মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। মিয়া ছাওয়ালের সাথে মিলনের প্রেম ছিল। তাই আমরা গ্রামবাসী মিল্যা তাদের বিয়্যা দেবার ব্যবস্থা করিচ্ছি।
কথা হয় ভুক্তভোগী মেয়ের বাবা মায়ের সাথে। মাতবরের সুরে সুর মিলিয়ে মেয়ের ধর্ষণের কথা অস্বীকার করেন তারা। ভুক্তভোগী মেয়েটির সাথে কথা বলতে চাইলে সবাই বলে মেয়েটি বাড়িতে নেই, ফুপুর বাসায় বেড়াতে গেছে। গ্রামবাসীর অনেকেই তাদের এই কথায় সুর মেলায়।
পরে অনেকটা হতাশ হয়ে সেখান থেকে চলে আসতে হয়। পরে এই প্রতিবেদক অভিযুক্ত মিলন হোসেনের বাবা আল আমিন মন্ডলের সাথে কাথা বলতে যায়। এসময় ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। আল আমিন মন্ডল বলেন, গ্রামের মাতবররা মিলে ষড়যন্ত্র করিচ্ছে।
আমার ছেলে মিলনের প্রতি ধর্ষণের অভিযোগ এনে এখন জোর করে বিয়া করায় দিতে চাচ্ছে। আমার ছেলে অকাম করলে ঘটনার দিন ছাইড়্যা দিল ক্যা? ধরে বাইধ্যো রাখতে পারলো না? আমি এটা মানব্যো না। আইনে যা হয়, তাই হবি।
এসময় তার কথা শুনে এগিয়ে আসেন, মাতবরদের একাংশ বাফাজ উদ্দিন, বাবলু হোসেন, আলতাফ হোসেন। বাবলু হোসেন জানান, ধর্ষনের ঘটনা ঘটার পরপরই গ্রাম্য শালিশ বসানো হয়েছেল। সেখানে সিন্ধান্ত দেয়া হয়। এই ঘটনা নিয়ে থানা পুলিশ করা যাবি ন্যা। দেড় লাখ টাকা কাবিন ধরে ছেলে মেয়েকে বিয়ে দেয়া হবি।
এরপর কয়েক দফায় বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। ছেলে-মেয়ের পরিবার আমাদের সিন্ধান্ত মেনেও নিয়েছে। এখন ছেলের বাপ তালবাহানা করিচ্ছে। ধর্ষণের মতো অপরাধ মিমাংসা যোগ্য কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এটা গ্রারামের ব্যাপার। যেহেতু আমরা গ্রামে নের্তৃত্ব দিই, সেহেতু গ্রামের ভাল মন্দ আমাদেরই দেখতে হবি।
গ্রামের আরেক প্রভাবশালী আলমগীর হোসেন দলবল নিয়ে হাজির হন এই প্রতিবেদকের সামনে। তিনি বলেন, আমরা মিচুয়্যাল করিচ্ছি। মিয়াডা খুবই গরীব। আমরা বিয়ে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করবো। কে কে এই বিচার প্রক্রিয়ায় আছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আলতাব, বাবলু, খোরশেদ, হাছেন, নজরুল মেম্বার, কুরমান, জনাব, সজল, আলামিন, রবিউল, বাফাজ উদ্দিনসহ আরও অনেকেই ছিল।
তাদের সাথে কথা বলে পুণরায় ভুক্তভোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ধর্ষণের স্বীকার নবম শ্রেণী পড়–য়া স্কুল ছাত্রীটি বারান্দায় মনভার করে বসে আছে।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে জানায়, গত ২৭ মে বাড়ির পাশের হাসেন মন্ডলের মুদি দোকানে মশুর ডাল কিনতে যায় সে। ফেরার সময় ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। পথে একই এলাকার মিলন হোসেন মুখ চেপে ধরে পাশের নির্জন একটি বাড়িতে নিয়ে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এসময় তার চিৎকার এলাকাবাসী এসে তাকে উদ্ধার করে। ঘটনার পরপরই কৌশলে পালিয়ে যায় মিলন।
মেয়েটি আরও বলেন, গ্রামের মাতবররা বিয়ে দেবার উদ্যোগ নেয়। হতদরিত্র হওয়ায় সেও তার মা-মায়ের সিন্ধান্ত মেনে নেয়। কিন্তু বিয়ের আশ্বাসে এক সপ্তাহ পার হলেও সবাই তালবাহানা করতে থাকে। মিলনের পরিবার প্রভাবশালী। তার এক চাচা, নাম জনি।
তিনি বিদেশ থেকে কলকাঠি নাড়ছে। টাকা দিয়ে মাতবরদের অনেককে ম্যানেজ করেছেন তিনি। সঠিক বিচার না হলে মিলনের বাড়িতে গিয়ে বিষ খেয়ে অথবা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার কথা জানায় মেয়েটি।
গ্রাম্য মাতবরদের কাছে বিচার না পেয়ে অবশেষে ভুক্তভোগীর পরিবার থানা পুলিশের দারস্থ হয়েছেন। ০৫জুন ধর্ষণের অভিযোগ এনে মিলনকে একমাত্র অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীর বাবা।
এরপরই দুউভাগে ভাগ হয়ে গেছে গ্রাম্য মাতবররা। একপক্ষ থানা পুলিশ করায় তাদের ইমেজ ক্ষুন্ন হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবারের উপর চড়াও হয়েছে। গ্রাম্য মাতবরদের একলু বাবলু জানান, থানা পুলিশ করিছে। এখন থানা পুলিশ দেকপি। আমরা আর এর সাথে নাই। একই কথা জানান আরেক গাম্য মাতবর আলমগীর হোসেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নাটোর সদর থানার উপ-পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম জানান, মিলন হোসেনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের হয়েছে। ইতিমধ্যে ভিকটিমের ডাক্তারী পরিক্ষা ও আদালতে জবানবন্দি সম্পন্ন হয়েছে। ঘটনাটিতে গ্রাম্য মাতবরদের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
বিচারের নামে অসহায় একটি পরিবারের সাথে এমন লুকোচুরি খেলা ঠিক নয়। পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহার নির্দেশে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। অপরাধি ও অপরাধকে প্রশ্চয় দেয়া কেউ-ই ছাড় পাবে না।
পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা জানান, ধর্ষণের মতো অপরাধ বিচার শালিস করার মতো অপরাধ নয়। ঘটনার সাথে জড়িত কেউ ছাড় পাবে না।
