
সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ নিয়ে কি লিখবো? কি লেখা যায়? ইদানীং আর কিচ্ছু লিখতে ইচ্ছে করেনা। তবে এটুকু বুঝেছি, যতদিন প্রত্যেক পরিবারে মানুষ তৈরি না হয়ে পুরুষ মানুষ তৈরির কারখানা বন্ধ না হবে ততদিন ধর্ষণ হওয়া বন্ধ হবেনা। যখনই কোন পুরুষ ধর্ষণ করে তখন সে প্রথম আশ্রয় পায় তার পরিবারে।দেখা যায়, পরিবারে মা থেকে শুরু করে বোন, বউ কিংবা যেকোন নারীর ছত্রছায়ায় সে আশ্রয় পায়। আর নারী তখনই জেনেবুঝেই বড় ভুল করে। যদি প্রশ্ন আসে মায়ের আবেগ নিয়ে , তখনই নারীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভুল করে পরিবার তথা সমাজ ও রাষ্ট্র।
মা বাবা পরিবারের অগ্রগামি ব্যক্তি হলেও ছোটবেলাতে যখন একটা শিশু বেড়ে ওঠে তখন মা ই শিশুকে তার মেধা, মনন ও চিন্তা দিয়ে সামাজিকীকরণে বিশাল ভুমিকা পালন করে থাকে। সেই সামাজিকীকরণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে জেন্ডার বায়াসনেস থেকে। ফলশ্রুতিতে প্রথমেই ছেলে শিশুকে তার চিন্তায় পুরুষ বানিয়ে তোলে আর মেয়ে শিশুকে নারী হিসেবে গড়ে তোলে। যেখানে প্রথাগত ভাবে পুরুষ হল শাসক, আধিপত্য বিস্তারী বলবান আর নারী হল ক্ষুদ্র, মলিন, নিগৃহীত এবং করুণা লাভের জন্তু।
পরিবারেই ছেলে শিশুটা দেখে কিভাবে তারই মা, বারবার মা বলছি! কারণ, এখন পুরুষতন্ত্রের চর্চা নারীর মধ্য এমনভাবে প্রোথিত হয়েছে যে পুরুষের চেয়ে বরং নারীই পরিবারে পুরুষতন্ত্রের চর্চা বেশী করে থাকে। খাবার বন্টন, পোশাক থেকে শুরু করে মায়ের প্রথম পাঠ হয়, মেয়েদের এটা করতে হয়না, ওটা করতে হয়না। কিংবা ছেলেদের কি করা উচিৎ ইত্যাদি। সংসারে যৌতুকের জন্য ছেলের বউয়ের উপর নির্যাতনে নারীও কম যান না। কিছুদিন আগে স্কুল ছাত্রীকে তুলে নিয়ে অপর এক নারীর হাতেই ওই স্কুল ছাত্রীর চুল কেটে দেয়ার ভিডিও ফেসবুকে বেশ সয়লাব হয়েছে। এছাড়া পৃথিবীর অধিকাংশ মা ই মনে করে তার ছেলে নিস্পাপ এবং সচ্চরিত্রবান। এ ধারণার পরিবর্তন প্রয়োজন।
আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগ বহু আগে শেষ হলেও এখনো সন্তান জন্মদানের পূর্বে নারীর উপরে প্রেসার আসে পুত্র সন্তান জন্মদানের। অনেক নারী হয়তো তা মেনেও নেয় কেননা পুত্র সন্তান বংশের প্রদীপ। হোকনা সে ধর্ষক কিংবা পুরুষ মানুষ। আজও অনেক শিক্ষিত পরিবারের বাবা-মাকে বোঝানো শক্ত যে একজন নারী চাইলে সেও বংশের প্রদীপ হতে পারে। কিন্তু স্বার্থপর জাতি হিসেবে সব কিছুকে আমিত্ত্বকরণের ফলে ছেলে শিশুকে শেষ জীবনের সহায় ভাবে। মেয়ে শিশু সেতো অন্য বাড়িতে চলে যাবে ভেবে অনেক কিছু থেকে নিজের পরিবারেই সে বঞ্চিত হওয়া শুরু করে। যদিও সমীকরণে দেখা যায়, আজকাল ছেলে সন্তানের তুলনায় মেয়ারাই বরং বাবা-মাকে বেশি দেখাশুনা করে।
যদি বলা হয় ক্ষমতার প্রসঙ্গ, পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান হয়তো নারী ধর্ষণের একটা কারণ। তবে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে থাকা নারী প্রধানমন্ত্রী কি পেরেছে সবটা সামাল দিতে? সেটা কি আসলে সম্ভব যেখানে বৃত্তের চারপাশে পুরুষ। স্বাধীনতার পর থেকে বিবেচনায় নারী এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা এগিয়ে কিন্তু নারী ধর্ষণের সংখ্যায় কি পুরুষ পিছিয়ে আছে? আর নারীর এগিয়ে যাওয়াই হয়তো নারীর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরুষের চোখে। আঁতে ঘা লাগে। ধর্ষণ এখানে আধিপত্য বিস্তারের পুরুষতন্ত্রের আরেক রূপ। তারই ভিন্ন প্রকাশ হল, যখন নারী ধর্ষণের শিকার হয় তখন মূল ঘটনা ছাপিয়ে নারীর চরিত্র, পোশাক,ধর্মীয় অবস্থান এবং সামাজিক অবস্থানকে বড় করে তুলে ধর্ষণের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা। যে দেশে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানলে আইন সোচ্চার হয়, ব্যক্তি সোচ্চার হয় সে দেশে ধর্ষণ কি করে হয়? এরা কি সকলে নাস্তিক? তাহলে মন্দির, মসজিদ, গির্জায় ধর্মীয় গুরু দ্বারা ধর্ষণ হত না। আসলে ধর্ষকের কোন ধর্ম, শ্রেণি, দেশ, কাল কিংবা দল নেই। এরা সকল স্থানে বিদ্যমান। এদের যারা ছত্রছায়া দেয় তাদের মধ্য হয়তো পূর্বে কেউ ধর্ষক ছিল কিংবা ভবিষ্যতে ধর্ষণের সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এটা ভাবার সুযোগ নেই যে, আমি বা আমার পরিবার ধর্ষণ মুক্ত। প্রত্যেক পরিবার, স্থান এবং দলেই একজন খন্দকার মোস্তাক বা মীর জাফর লুকিয়ে আছে।
আর পুরুষ হিসেবেও গর্ব করার কিছু নেই, প্রতিবছর ছেলে শিশুদের বিরাট একটা অংশ পুরুষের দ্বারাই বলাৎকারের (ধর্ষণ) শিকার হয় যা মিডিয়াতে আসে না কিংবা পুরুষের সতীত্ব হয়তো খুব শক্ত বলে সতীত্ব হারায় না। তবে নারীর সতীত্ব কি এতই সস্তা? তা নয়। ধর্ষণের পরে সামাজিক যে হেনস্থা, সেটা হয়তো ধর্ষণের শিকার সকল নারীদের মেনে নেয়ার মানসিক জোর থাকে না। যারা বের হয়ে আসে তাদের আমরা নানা বিশেষণে ডাকি। এছাড়া যারা এসব নারীদের পাশে দাঁড়ায় তাদেরকে আপনারা ভাবেন যে আন্দোলনরত প্রত্যেক নারীই হয়তো ধর্ষণের শিকার অথবা আন্দোলনরত পুরুষ হিসেবে তারা নপুংসক। ভাবুন। কিছু আসে যায়না। এ রাষ্ট্র আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালালে কিংবা ধর্ষক আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। পুরুষ শক্তি সাধনায় যে কালীর পুজা করে, কালী হয়তো একদিন খড়গ হস্তে সেই পুরুষ অসুরের মুণ্ড নিপাত করবে। আর এ অবস্থার উত্তরণে নারীকেই বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে, সোচ্চার হতে হবে। তবে, প্রতিবাদ নিয়ে যেন নিজেদের মধ্য সংশয় তৈরি না হয়। এ জন্য সর্বদা যে রাজপথে নামার প্রয়োজন তাও নয়। কারণ, যেকোনো পরিবর্তন ঘর থেকেই শুরু করতে হয়।
লেখক:- লাবনী আকতার
এম ফিল গবেষক
বাংলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
