
স্কুল জীবন, অর্থাৎ ১০-১৬ বছরের সময়টাই হয়তো জীবনের জন্য সবচে’ আনন্দের। আশির দশকে কোন এক মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা মানুষ হিসেবে-এটা আমার জীবনের মূল্যায়ন। কারো কারো ক্ষেত্রে স্কুলের চেয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা মধুর মনে হতেই পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস বেশীর ভাগ মানুষ, অন্তত চল্লিশ পেরুনোর পর অধিকাংশই-ক্লাস ফোর/ফাইভ থেকে ম্যাট্রিকের পরীক্ষা টেনশন ছাড়া পুরো স্কুল জীবনটার কাছে ফিরে যেতে চাই বারবার। আহ্ কত দূরন্ত জীবন।
মফস্বল বা কোন জেলা-উপজেলায় বাস করা মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া মানে…. সেটা স্কুলের দায়িত্ব ছিল। বছর শেষে সম্মানজনক মার্ক নিয়ে পরের ক্লাসে উঠতে পারলেই হলো। লেখাপড়াতে মানে অংক আর ইংরেজী সমস্যা হলে বাসায় একজন গৃহশিক্ষক বা প্রাইভেট স্যারের বন্দোবস্ত করতেন বাবা। সেই একজন প্রাইভেট স্যার বাসার সব ভাইবোনের জন্য। ম্যাট্রিকের আগে প্রয়োজন হলে বাড়তি যত্ন। বাড়তি শিক্ষক। ব্যাস।
অন্যদিকে, স্কুলে স্যাররাও চাইতেন ছাত্র/ছাত্রীরা নিয়মিত স্কুলে এসে পড়াশোনায় মনোযোগি থাকবে। ব্যাস ওই জীবনে এতটুকুই চাপ। বাকিটা পুরোই আনন্দ……
স্কুলে প্রায় সব স্যারদের নিয়মানুবর্তী কঠোরতার পাশাপাশি এমন কোন কোন স্যার ছিলেন, যারা বইয়ের বাইরে পৃথিবী দেখাতেন। সোজা করে বললে, বাহুল্য হবে না-তাদের আদরে-আস্কারায় জীবনটা আনন্দময় শিক্ষালয় হিসেবে মনে হতো। আমার স্কুল জীবনে যে অল্প ক’জন স্যার সেই আস্কারাময় শিক্ষায় আমাকে বড় করে তুলেছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন ‘নাসিহ্ স্যার’। সহজ করে তাঁকে আমরা ডাকতাম ‘নাছির স্যার’। পুরো নাম ‘সৈয়দ মুহাম্মদ নাসিহ্’।
স্কাউট শিক্ষক হিসেবে সেই ক্লাস থ্রি থেকেই তাঁর সানিধ্য পেয়েছিলাম। মাঝে কিছু সময় কি যেন কারনে দেলোয়ার স্যার স্কাউট স্যার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অসুস্থতা এবং মৃত্যুর পর আবারো নাসিহ্ স্যার সেই দায়িত্ব নেন। শরিরী শক্তিমত্তার বাইরে মন আর মেধা দিয়ে যে অনেক কিছু অর্জন সম্ভব-সেটা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েন তিনি। চোখ বন্ধ করলে নাসিহ্ স্যারের যে কয়টা রূপ দেখতে পাই-তার অন্যতম একটা হলো, স্কাউট ড্রেস পরা স্যার বাই সাইকেল চালিয়ে ছুটে চলেছেন।
ক্লাসে এবং বাইরে ছাত্রদের কাছে প্রিয় এই শিক্ষক স্কুল কর্তৃপক্ষেরও আস্থা তৈরী করেছিলেন নিজ গুনে। আর সেই কারনে পুরানো স্কুলের পাশাপাশি নতুন ভবনে (এখনকার নাটোর সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়) প্রাইমারী শাখা স্থানান্তরে তার ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি ওই শাখার প্রধান ছিলেন।
স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে স্কুলে এবং বাইরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা বা অনুষ্ঠান আয়োজন বা যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন। তার নেতৃত্ব কতবার যে আমি-আমরা বাৎসরিক মৌসুমি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি, ঠিক নেই। পিটিআই স্কুল, উপজেলা পরিষদ মিলনায়তন (ফুলবাগান) বা জেলা পরিষদ মিলনায়তনে সেসব অনুষ্ঠানে স্যারের নেতৃত্বে যোগ দেয়া মানেই পুরোটা দিন হতো আনন্দময়। কানাইখালী মাঠে স্বাধীনতা আর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নেয়া এবং তার আগের প্রস্তুতির দিন গুলোতে স্যারের সাপোর্ট স্কাউট টিমের কেউই ভুলতে পারবে না।
জেলা শহরের বাইরে বাড়ী বা মা-বাবা ছাড়া স্কাউট ক্যাম্পে গিয়ে কতটা দায়িত্বশীল হতে হয়-সেসবের বাস্তবিক শিক্ষাও তো সেই নাসিহ্ স্যারই আমাকে শিখিয়েছিলেন। শুধু নিজেদের স্কাউট দল না, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অন্যান্য দল গুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় কিভাবে নিজেকে যোগ্য করে তুলে ধরা যায়, স্যারের সেই শিক্ষা……
স্কুল, স্কাউটিং বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা … অর্থাৎ যতসব এ্যকস্ট্রা কারিকুলার এ্যকটিভি ছিল, তার প্রায় সব ক্ষেত্রেই নাসিহ্ স্যার আমাকে-আমাদেরকে উজ্জিবিত করেছিলেন। আর সে জন্যই তো প্রথমেই স্বীকার করেছি স্কুল জীবনটা একঘেয়ে কস্টকর মনে হয়নি। তবে, বইয়ের বাইরের সব আনন্দ শুধু নয়, বইয়ের পড়া মানে-সিলেবাসের ক্ষেত্রেও তার সহযোগিতা ছিল অসাধারণ।
ক্লাস নাইন ও টেন-এ তার বাসায় গিয়ে ইংরেজি পড়ে আসতাম অনেকটা বাড়তি ফি ছাড়াই। স্যারের আলাইপুরের অতি সাধারন অবকাঠামোর বাসায় যেতাম। কখনো বারান্দা, কখনো উঠানে খোলা আকাশের নীচে ইংরেজী পড়াতেন স্যার।
দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ওই বাসায় থাকতেন তখন। স্যারের স্ত্রী, খালাম্মা আমাকে পরিবারের সদস্য মনে করেই স্নেহ করতেন। আর তিন ছেলে মামুন, মাসুম এবং মিঠুন স্যারের প্রায় ছাত্রদেরকে ভাই-ই মনে করতেন। সেই থেকে তিন দশক পেড়িয়ে গেছে, এখনো মামুনদের সম্পর্কটা আলাদা হয়নি। কিছুদিন আগেও কানাডার টরেন্টোতে মিঠুনের সাথে দেখা হলো। কতটা আপন মনে হচ্ছিল। মিঠুন যে কানাডা থাকে সেটাও আমি কানাডা মুভ করার পর স্যারই আমাকে জানিয়েছিলেন।
অন্যদিকে, নাসিহ্ স্যারের প্রথম পরিবারের সদস্যদের সাথেও আমার/আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট। নিউটন ভাই, মিল্টন ভাই, বায়রন আর মৌ আপা… উনাদের আম্মা গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। আমার বোনদের টিচার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিউটন ভাই স্কুলে স্কাউট লিডার ছিলেন। এখনো তিনি ছোট ভাইয়ের মতই স্নেহ করেন। মিল্টন ভাইও কানাডা প্রবাসী। থাকেন আমার শহর থেকে ১০০ কিমি দূরে। কোনো কারনে যদি উনার শহরের দিকে যাই, আর মিল্টন ভাইয়ের সাথে দেখা না করি-তাহলে খবর আছে! ভালবাসাটা এমন পর্যায়ের। মৌ আপা বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেন। আমিও সেই পেশাতেই ছিলাম। অনেকেই তাকে চেনেন। তারা জানেন-কতটা সংগ্রামী তিনি। সততা আর মানবিক মূল্যবোধে তার অবস্থান কতটা দৃঢ়।
স্যারের কথা বলতে গিয়ে, তার ছেলে-মেয়েদের কথা কেন বলছি?
নাসিহ্ স্যারের ছেলে-মেয়েদের কথা বলছি, এই কারনে যে-তিনি একজন শিক্ষকের পাশাপাশি বাবাও বটে। বাবা হিসেবে সন্তানদের জন্য কেমন মূল্যবোধ তৈরী করতে পেরেছিলেন-সেটাও কম না। ….. বলতে পারি নাসিহ্ স্যারের এমন কোন ছাত্রও নেই যে নৈতিকতা-সততা হারিয়েছে। একজন ছাত্র হিসেবে স্কুলের অন্যান্য স্যারদের মূল্যবোধও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে, আমি বলতে পারি আমার জীবনে নাসিহ্ স্যারের অবদান কতটা প্রবল।
আরেকটা উদাহরণ মনে পড়ছে— বাংলাদেশে আমার জীবিকার পরিচিতি ‘সাংবাদিকতা’। সেই সাংবাদিকতার শুরুতে কিছুদিন আমি ইংরেজী দৈনিক ‘The Telegraph’ -এর নাটোর প্রতিনিধি ছিলাম। তো সেটা ১৯৯২-এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৯৩ সালের কিছু সময়। ইংরেজীর ‘ই’ বুঝি না! কিন্তু ইংরেজী দৈনিকে কাজ করি। সেই সময় যাদের সাহায্যে কাজটা চালিয়ে নিচ্ছিলাম, তাদের অন্যতম একজন- নাসিহ্ স্যার। কেন ধরনের ফিচার টাইপ বড় সাইজের রিপোর্ট হলেই খসড়া কপি নিয়ে যেতাম স্যারের কাছে। পরীক্ষার খাতার মত লাল কালি দিয়ে সংশোধন করে দিতেন কোনো বিরক্তি ছাড়াই। বুঝিয়েও দিতেন লেখার ক্ষেত্রে গ্রামার বা স্যানটেন্স গঠনে কোথায় কোথায় ভুল করছি। ক্লাস, পাঠ্য বই, এ্যাকস্ট্রা কারিকূলার এ্যকটিভিটি, স্কাউটিং, বাসায় টিউশনি …… এত কিছুর পর স্যারের এই বাড়তি যত্ন কতটা …… তা বোঝানো মুশকিল।
আমার বা আরো ছাত্রদের প্রতি নাসিহ্ স্যারের এত ধরনের যত্নের পর নিজেও কত ধরনের কাজ করতেন! সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোর সাথে সক্রিয় থেকেছেন আজীবন। হোমিওপ্যাথ প্র্যাকটিস করতেন সেই সময় থেকেই।
নাটোরের মত মফস্বল শহরে বাস করে এক জীবনে কতটা বহুমাত্রিক হওয়া যায়, তার জীবন্ত প্রমাণ ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ নাসিহ্ স্যার। বাতিঘর হিসেবে আলোক বর্তিকা ছড়িয়ে গেছেন আমার মত কিশোর-তরুনদের মনে… ভালো থাকবেন স্যার …
লেখক: এসএম বাবু, কানাডা প্রবাসি।
