
সুব্রত কুমার পাল:
আরশাদ আলী ওরফে আশু মোড়ল, বয়স ৮২। সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম নারায়নপুর গ্রামে বেড়ে উঠা মানুষটির স্বপ্ন এক নজর প্রধানমন্ত্রীকে কাছে থেকে দেখা ও কথা বলা। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ মাসের শেষে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি থানার চাপতা বাজার থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে রাজাকারের চোখ এড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল কে সঙ্গে করে নিয়ে যান ভারতে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে আবার দেশে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে। এখনও তিনি প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রীকে এক নজর দেখার।
আরশাদ আলীর মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ৩৪ বছর। অভাব আর অনটনে খুব বেশী দূর এগোয়নি লেখাপড়া। অভাবের সংসারে দুমুঠো অন্ন যোগাড়ে খুলনা থেকে সার এনে বিক্রি করতেন, তা থেকে যা আয়, তাই দিয়েই চলতো তার সংসার। সে সময় খুলনার তারপুকুর শান্তিধামের মোড়ে দরবার মেডিকেলের বারান্দায় আরশাদ আলী মোড়লের সাথে দেখা হয় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি থানার চাপতা বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান মিনার সাথে। দেশের পরিস্থিততি খারাপ হওয়ায় তাকে বাড়ীতে নিয়ে যায়।
সেখানে দুদিন থাকার পর পাশের ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর যখন বাড়ী ফেরার ইচ্ছা করলে সেখানে গিয়ে জানতে পারেন তার সঙ্গে থাকা দুজন মানুষই মুক্তিযুদ্ধের আহŸানকারী শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল হোসেন এবং ভাগ্নে ইলিয়াছ। এ কথার শোনার পরই শিহরিত হয়ে উঠেন আরশাদ আলী ওরফে আশু মন্ডল। পরদিন ভোরেই শুরু করেন তার রোমাঞ্চিত যাত্রা।
পাসকার নদী পেরিয়ে বহুপথ পাড় হয়ে পাক বাহিনী আর রাজাকারদেও চোখ ফাঁকি দিয়ে নড়াইল জেলার সীমান্ত এলাকা গাজীরহাটে পৌছান। সেখান থেকে আবার ইছামতী নদী পাড় হয়ে ভারতে পাড়ি দেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে । পরদিন ভার যাত্রা শুরু করে পানকার নদী পেরিয়ে চর বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে যশোর, খুলনা ও গোপালগঞ্জের সীমন্ত গাজীরহাটে আসেন। সে সময় পরিচায় ঘটে একই এলাকার চেয়ারম্যান হামু চেয়ারম্যানের সাথে। তার সহায়তা নিয়ে পাকসেনা ও রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে তারা রেলগট থেকে সুশীলগাতি হয়ে দৌলতপুরে আসনে। সেখান থেকে গল্লামারী গণরেডিও সেন্টারের পাশ দিয়ে কৈয়া বাজারের আগের একটি পথ বেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে বটিয়াঘাটা এলাকার সরাফপুর পৌঁছান তারা। সেখান থেকে তারা নৌকায় পাইকগাছার উদ্দেশ্য রওনা দেন। পথিমধ্যে মাঝির পরিচিত একটি বাড়িতে যেয়ে তারা খাওয়া দাওয়া করেন। তখন মাগরিবের আযান হয়। এভাবেই তার মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের গল্প কথা।
যে সেক্টওে প্রশিক্ষণের জন্য যান সেখানকার খান মেজর জলিল ছিলেন ৯নং সেক্টর কমান্ডার। ১৪ দিন ট্রেনিং দিয়ে সেখান থেকে কামাল, ইলিয়াসের সাথে তাকেও হাসনাবাদ ফিরিয়ে আনা হয়। সেখান থেকে কালিগঞ্জ এসে একদিন বাড়িতে রাখার পর কামাল ও ইলিয়াছকে গোপালগঞ্জ পোঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরেনি তিনি। বাড়ি ফিরেই আবার চলে যান হাসনাবাদ টাকীতে। সেখান থেকে সহকর্মীদের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাকসেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নামেন তিনি দেশ মাতৃকার টানে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
আলাপচারিতায় মুক্তিযোদ্ধা আশু মোড়ল আরো বলেন, ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালিগঞ্জ এসেছিলেন। নির্বাচনের জন্য তিনি সোহরাওয়ার্দি মাঠে এক মঞ্চে এক ঘণ্টা বক্তব্যে দেন। সে সময় মঞ্চে ছিলেন ডা. হযরত আলী, গাজী আবু সাঈদ, বেতার শিল্পী শান্তি গোপাল চক্রবর্তী, শীতলপুরে মনির আহম্মেদসহ কয়েকজন। আশুমোড়ল সে সময় সেখানেই ছিলেন, গড়ে উঠেছিলো সকলের সাথে সখ্যতা।
আশু মোড়ল আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, শেখ কামাল ও ইলিয়াছকে সাক্ষাৎ পাক হানাদারদের কালো থাবা থেকে রক্ষা করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। একসাথে ট্রেনিং নিয়েছেন। ১৯৬৯ এ বঙ্গবন্ধু কালিগঞ্জে এসে কালিগঞ্জবাসিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উৎসাহিত করেছেন। অথচ যারা সেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তাদেরই স্মরণীয় কীতি সম্পর্কে কালিগঞ্জ কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই। এমনকি পশ্চিম নারায়নপুর হাসপাতালের পেছনে পাক সেনারা একইসাথে ১৪জনকে গুলি করে মাটিতে পুঁতে ফেলছিল। এছাড়াও ওয়াপদা ডাকবাংলার পাশে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজনকে গুলি করে ড্রেন দিয়ে লাশ খালে ফেলে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও সংরক্ষণ করা হয়নি ওইসব গণকবরগুলো।
১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর নারায়নপুর ডাকবাংলো থেকে পাকসেনাদের তাড়িয়ে সেক্টর কমান্ডার আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে লাল সবুজের পতাকে উড়িয়ে দখল নেন ঐ স্থান। আশু মোড়ল আক্ষেপের সুরে আরো বলেন, শেখ কামাল হোসেন ও ইলিয়াছ কে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের কালো থাবা থেকে রক্ষা করেই ভারতে নিয়ে গেছেন এবং এনেছেন। অথচ যারা সেই মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি তাদের কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই কালিগঞ্জে। যে পরিবারের সাথে তার এত গভীর সম্পর্ক, সেই পরিবারেরই মানুষ আজকের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চান তিনি।
