
বিশেষ প্রতিবেদক:
নাটোরের বড়াইগ্রামে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিল হতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচির আওতায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি অবগত হয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক আশরাফুল ইসলামকে তদন্তের দায়িত্বভার দেয়া হলেও তদন্তের নির্দিষ্ট সময় বেধে দেননি জেলা প্রশাসক। তদন্ত চলাকালীন সময়ে অসম্পূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠেন সংশ্লিষ্ঠরা। তবে অনিয়ম খতিয়ে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
সরেজমিনে গত ৩১ আগষ্ট নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিস চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, একজন শ্রমিক তড়িঘড়ি করে বিশ্রামাগার বা গোলঘরের মেঝে ঢালাইয়ের কাজ করছেন। প্রকল্পের মেয়াদ দুই মাস আগে শেষ হলেও এই অফিসের গোলঘর নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু গেল জুনেই এডিপির অর্থায়নে নির্মিত গোলঘর নির্মাণের সব টাকা তোলা হয়েছে। একই চিত্র আহম্মেদপুর আজম আলী কলেজের গেট নির্মাণ, বিভিন্ন সংস্কার কাজসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে। আহম্মেদপুরের স্থানীয় দুজন বাসিন্দা জানান, গত এক বছর ধরেই কলেজটির গেট নির্মাণ কাজ থেমে থেমে চলছে। এখনো কাজটি চলমান রয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে এডিপির ২৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের বেশ কয়েকটির কাজ শেষ না করেই ৬৮ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়। এছাড়া একই অর্থবছরে রাজস্ব খাতের ৬২টি উন্নয়ন কাজের জন্য ব্যয় দেখানো হয় দেড় কোটি টাকা। যার মধ্যে মধ্যে অধিকাংশ কাজই বাস্তবায়ন হয়নি। গত জুন মাসে রাজস্ব খাতের উন্নয়ন কাজের সময় দুই মাস পেরুলেও তালিকায় থাকা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সরকারী দপ্তরের অনেক কর্মকর্তারা জানেন না তাদের প্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন বরাদ্দের কথা। স্থানীয়রা এই ঘটনায় সঠিক তদন্ত ও দোষীদের বিচার দাবি করেন।
জোয়ারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আকবর জানান, ২২-২৩ অর্থ বছরে তাদের ইউনিয়নের বাসিন্দাদের জন্য সেলাই মেশিন বাবদ দুই লাখ টাকা বরাদ্দের কথা তার জানা ছিল না। সেলাই মেশিন তারা পাননি। অন্যান্য বরাদ্দ ঠিকঠাক মতই পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার রেহানা পারভীন ও সোনালী খানম জানান, ২২-২৩ অর্থবছরে উপজেলা শিক্ষা অফিসে নতুন একটি টয়লেট বরাদ্দ ছিল। এটি তারা জানেন না। নতুনভাবে তাদের অফিসে টয়লেট নির্মাণ হয়নি উল্লেখ করে দুজনই জানান, কিছুদিন আগে উপজেলা প্রকৌশলী রবিউল আলম টয়লেট নির্মাণের স্থান দেখে গেছেন। দ্রæতই টয়লেট নির্মাণের আশ্বাস দিয়ে গেছেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল বারী জানান, এডিপি ও রাজস্ব কাজের কিছু কাজ হয়েছে। কিছু চলমান আছে। কিছু কাজ একেবারেই হয়নি। এটা জানাজানি হওয়ার পর জেলা প্রশাসন থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি হওয়ার পর অসমাপ্ত কাজগুলো তড়িঘড়ি করে শেষ করা হচ্ছে। এই অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার দাবী জানান তিনি।
তবে প্রকল্প সংশিষ্ঠদের দাবি, দু’একটি কাজ বাদে এডিপির অধিকাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জুনেই মধ্যেই এডিপির অর্থ উত্তোলন করার বাধ্যবাধকতা থাকায় ৬৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন তারা। অপরদিকে, তদন্ত চলাকালিন সময়ে গত ২৪ আগষ্ট উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব তহবিলের কাজের সময় বৃদ্ধি করা হয়। এরপরই কর্মকর্তারা দাবী করেন, সব কাজই হয়েছে নিয়মমাফিক।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলী রবিউল আলম জানান, গত অর্থবছরে এডিপির সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। আর রাজস্ব থেকে এডিপিতে স্থানাস্তরিত অনেক কাজ শেষ হয়েছে। কিছু কাজ এখনো বাকি আছে। বিষয়টি মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। সেখানে সিন্ধান্ত হয়েছে ৩০ সেপ্টেম্বরের মাঝেই কাজগুলো শেষ করতে হবে। কাজ না করেই টাকা উত্তোলনের সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্ন এড়িয়ে তিনি জানান, ঠিকাদারদের কাজ শেষ করতে বার বার তাগাদা দেয়া হচ্ছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী জানান, সব কাজই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়েছে। দু একটা কাজের একটু ত্রæটি ছিল। সেটা পর্যবেক্ষণ করে ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছি। আর রাজস্ব এডিপির এখনো অনেক কাজ অসম্পূর্ন আছে। যা উপজেলা সমন্বয় মিটিংয়ে ৩০ সেপ্টেম্বরকে লাষ্ট লিমিট ধরে ঠিকাদারদের কাজগুলো শেষ করতে বলা হয়েছে। আমরা নিবিড়ভাবে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছি যাতে কাজগুলোর ত্রæটি বিচ্যুতি না হয়। জেলা থেকে তদন্ত কমিটি গেলেও তার সাথে কথা হয়নি বলে জানান উপজেলা চেয়ারম্যান।
বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মারিয়াম খাতুন বলেন, ৩০ জুনের মধ্যেই অর্থ ছাড়ের বাধ্যবাধকতা থাকা সহ তিনি ও উপজেলা চেয়ারম্যান হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি যাওয়ার কারণে অর্থ ছাড় দিয়েছিলেন। তখন কাজ চলমান ছিল এবং কাজগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে রাজস্বের কিছু কাজ নানা কারণে শেষ হয়নি। যা বিধি মোতাবেক সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই সাথে উপজেলা প্রকৌশলীকে কাজগুলো দ্রæত বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরপরও উপজেলা প্রকৌশলী কালক্ষেপন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক আশরাফুল ইসলাম জানান, ইতিমধ্যে তিনি তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। তদন্ত চলমান রয়েছে।
জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঁঞা জানান, বড়াইগ্রাম উপজেলায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচির আওতায় স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিল হতে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এতে কিছু অনিয়মের বিষয়ে অবগত হয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক আশরাফুল ইসলামকে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেবার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাবার পর প্রশাসনিকভাবে যে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া দরকার তা করা হবে। অনিয়মকারীদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবেনা।
