
নাটোরের সদর উপজেলার বারঘরিয়া গ্রামের প্রতিবন্ধী নারী জুলেখা আক্তার জুলি। দুই পায়ের সমস্যা হওয়ায় চলাফেরা করেন হুইলচেয়ারে। এলাকায় কথিত আছে জনৈক এক প্রতিবন্ধী সংস্থার মাধ্যমে জুলেখা ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন দুইবার। সেখানে তার পরিচিত কোম্পানিতে ‘মেডিকেল কেয়ার ওয়ার্কার’ হিসেবে লোক পাঠানোর সুযোগ রয়েছে।
তার জন্য প্রয়োজন ১৮ লাখ টাকা। তবে প্রথমে ৫ লাখ টাকা জুলেখার কাছে জমা দিতে হবে আর বাকি টাকা দিতে হবে লন্ডনে যাওয়ার পরে। লন্ডনে সেই কাজের জন্য শ্রমিকদের প্রয়োজন নেই সাক্ষরতার সক্ষমতাও। জুলেখা ও এই চক্রের এমন প্রচারণায় তৈরি ফাঁদে পা দিয়ে অটোরিক্সা চালক থেকে শুরু করে শিক্ষিত তরুণরাও হয়েছেন সর্বস্বান্ত।
অভিযোগ উঠেছে নাটোর ও রাজশাহী জেলার ৫০ ব্যক্তি সহ সারাদেশের ৯৭জন মানুষকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাদের থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতিবন্ধী জুলেখা আক্তার জুলি ও তার চক্র। ভুক্তভোগীদের অভিযোগে এ চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। তবে এখনো ধোঁয়াছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন চক্রের মাস্টারমাইন্ড জুলেখা আক্তার।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- টাকা দেওয়ার পর সবাইকে একসঙ্গে ঢাকায় নিয়ে যায় চক্রটি। সেখানে ফ্লাইটের তারিখ বলে আর কোনো খোঁজখবর না নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তারা। প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে ভুক্তভোগীরা গ্রামে এসে টাকা ফেরত চাইলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন জুলি। পরে স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের শালিশেও হয়না এর সুরাহা।
এদিকে লন্ডনে যাওয়ার জন্য ব্যাংক লোন, সুদের টাকা, ধারদেনা ও শেষ সম্বল অটোরিক্সা বেঁচে টাকা দেওয়া ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর ঋণের বোঝা বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। অনেকে ঋণের ফাঁদে আটকে স্ত্রী- সন্তান ছেড়ে থাকছেন পালিয়ে পালিয়ে।
প্রতারণার শিকার সদর উপজেলার কাফুরিয়া পন্মাতপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামের স্ত্রী সাথী আক্তার ঢাকা পোস্ট’কে বলেন, আমার স্বামীকে লন্ডন নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রতিবন্ধী জলি। এর জন্য তাকে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানায়। পরে ২ লাখ টাকা লিজের ওপর(সুদ) ও ২লাখ টাকা কিস্তি তুলে মোট ৫ লাখ টাকা গুছিয়ে তাকে দেই। এরপর লন্ডন নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আরও ৪০ হাজার টাকা খরচ করিয়ে আমার স্বামীকে বাড়িতে দিয়ে পাঠায়।
তিনি বলেন, লিজের ওপর নেওয়া টাকা বাড়তে শুরু করেছে। কিস্তির টাকাও দিতে পারি না। পাওনাদারদের জন্য আমার স্বামী বাড়িতে থাকতে পারে না, পালিয়ে থাকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, খুব কষ্টে দিনপার করছি। সন্তানদের নিয়ে খেতে পর্যন্ত পাচ্ছি না। আমরা আমাদের টাকা ফেরত চাই, সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাই।
বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর গ্রামের ভুক্তভোগী রনি ইসলাম বলেন, কেয়ার ভিসায় লন্ডনে নিয়ে গিয়ে মাসে ৩ লক্ষ টাকা বেতন দেওয়ার কথা বললে আমি ও আমার ভাইয়ের জন্য ৮ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে লোন উঠিয়ে দেই। পরে আমাদের দেখে আমার এক মামাও যাওয়ার জন্য আড়াই লাখ টাকা জমা দেয়। প্রথমে আমার যাওয়ার কথা হওয়ায় ৩০ হাজার টাকার মার্কেট ও করি। পরে ঢাকা নিয়ে গিয়ে ৭ দিন রেখে ফ্লাইটের ডেট বলে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পরে ফোন করে আমাদের বাড়ি চলে আসতে বলে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এখন টাকা চাইলে টাকা না দিয়ে উল্টো শহর থেকে মাস্তান ভাড়া করে এনে হুমকি- ধামকি দেয়।
সদর উপজেলার বারঘরিয়া গ্রামের রাসেল আলী বলেন, আমাকে বলেছে সেই খানে মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা বেতন। মাঠে ঘাটে কাজকর্ম করে খাই বিদেশে গেলে সহজেই বড়লোক হতে পারবো। এই চিন্তায় গরু বেঁচে- লোন নিয়ে তাদেরকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। দুই বছর হয়ে গেছে টাকা দেয়া।
বিভিন্ন সময় নিয়ে যাওয়ার কথা বললে সে (জলি) বলে- আমার বস পালাইছে, এখন নিয়ে যেতে পারবো না। টাকা ফেরত চাইলে বলে- কাগজ পাতি এখনো রেডি হয়নি, কাজ চলছে।
রাজশাহী’র পুঠিয়া উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের হাবিবুর রহমান বলেন, ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমার থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিছে প্রায় এক বছর আগে। টাকা নেওয়ার পর আজ নিয়ে যাবো- কাল নিয়ে যাবো বলে কালক্ষেপণ করতে থাকে। পরে গত ৩ মাস আগে লন্ডনে নিয়ে যাবে বলে ৯৭ জনকে ঢাকায় নিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন ঢাকায় রেখে কারো সাথে দেখা না করেই সবাইকে বাড়িতে চলে যেতে বলে তারা। বাড়িতে এসে তাদের আর কোনো খোঁজখবর পাইনা।
তিনি বলেন, এনজিও থেকে টাকা গুলো সম্পূর্ণ লোন নিয়ে দিয়েছিলাম। এখন এনজিও’র লোকেরা টাকার জন্য বাড়িতে এসে বসে থাকে। আমি স্ত্রী সন্তান অন্যত্র লুকিয়ে রেখে এসেছি।
এঘটনায় সদর উপজেলার কাফুরিয়া গ্রামের ভুক্তভোগী আবু বকর বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে সদর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন- তিনি সহ ৯৭ জন ব্যক্তিকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ৫ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
এদিকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি শিকার করে অভিযুক্ত জুলেখা আক্তার জুলি বলেন, এলাকার গরীব- দুঃখী মানুষদের উন্নয়ন করতে চেয়েছিলাম। আমার বগুড়ার স্যার এস শাহাজাদা প্রথম আমাকে লন্ডনে লোক নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। পরে আমি ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা এলাকাবাসীর সাথে আলোচনা করলে অনেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করতে আসেন। পরে সকল প্রক্রিয়া শেষে যাওয়ার সময় হলে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন- তাকে খুঁজে বের করে গরীব-দুঃখী সব মানুষের টাকা দিয়ে দিবো।
এ বিষয়ে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম আহমেদ জানান, প্রতিবন্ধী জুলেখা একটি এনজিও’র মাধ্যমে একবার ইংল্যান্ডে যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে সাধারণ মানুষের মাঝে আস্থা সৃষ্টি করে প্রচার করে যে তার মাধ্যমে বেশ কিছু মানুষকে ইংল্যান্ডে পাঠাতে পারবে। সহজ সরল মানুষেরা তার সাথে যোগাযোগ করে ২ লাখ থেকে শুরু করে ৪ লাখ পর্যন্ত টাকা প্রদান করেন। মোট ৯৭ জন বিদেশ যাওয়ার জন্য তার কাছে টাকা দেয়। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায় তার পরিমান ২ কোটি টাকার মতো।
তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা বিদেশ যেতে না পেরে জুলেখার কাছ থেকে টাকা চাইলে সে টাকা দিতে অনিহা প্রকাশ করে। পরে ভুক্তভোগীরা এসে থানায় অভিযোগ জানালে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে অভিযোগটি মামলায় রুজু করি। সেই মামলায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করি।
প্রধান অভিযুক্ত প্রতিবন্ধী জুলেখা আক্তার জুলি পলাতক রয়েছেন। আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে, জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
