Home মুক্তমত ‘মাস্তান’ তৈরির কারখানা বন্ধ হবে কবে?

‘মাস্তান’ তৈরির কারখানা বন্ধ হবে কবে?

341
0

জোবাইদা নাসরীন
শিক্ষক,নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের গাড়ি মানেই অনেক দূর থেকে বিশাল জটলা। গাড়িটিও সাধারণ নয়, বেশ বিলাসবহুল। তার পাশে থাকে অন্তত এক-দুশ’ মোটরসাইকেল। সারিবদ্ধভাবে দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আরও এক-দুশ’ ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী। তারা দাঁড়িয়ে থাকে সালাম দেওয়ার জন্য, একটু হাত-বুক মেলানোর জন্য, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের একটু নজরে পড়ার জন্য। সেদিন সেদিকের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য। মোটরসাইকেলে আসা লোকজন ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের আশেপাশে থেকে মহড়া দেয়। এছাড়া থাকে তাদের দেহরক্ষীদের গাড়ি। ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক যেখানে যান সেখানেই এরকম চিত্র। শিক্ষক হিসেবে তো বটেই, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি ভীষণ লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। না, আমার শিক্ষার্থীদের গাড়ি আছে দেখে নয়, আমাদের শিক্ষার্থীরা কীভাবে আমাদের সামনেই এসব করছে, তা দেখে। তারা চাঁদা তুলছে, কাউকে তোয়াক্কা করছে না। কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না—তাদের এসব ক্ষমতা চর্চার টাকা কোথা থেকে আসে? কীভাবে তারা এত বিলাসবহুল গাড়ি কিনতে পারে? তাদের এতসব ধন সম্পদের উৎস কী? নিশ্চিতভাবে বলা যায় চাঁদার টাকায়। এখন ছাত্ররাজনীতি হলো টাকার পাহাড় বানানোর জায়গা, ক্ষমতা দেখানো আর মাস্তানির সবেচেয়ে বড় ক্ষেত্র। ক’দিন আগেই পত্রিকায় পড়েছিলাম—এই ছাত্রলীগ সভাপতির গাড়িতে কে উঠবে এটা নিয়ে দু’জন সহ-সভাপতি মারামারি করে আহত হন। এসবই জানা এবং আমরা এ ধরনের খবর দেখতে অভ্যস্ত।

গত পরশু রাত থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খবর ছিল ছাত্রলীগ সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগের বিষয়টি। তবে গত কয়েকদিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে,বিশেষ করে যখন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের বিষয় নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়ার আভাস দেন। এর আগে আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তাদের ক্ষমতা চর্চার অনেক পথ। বঙ্গভবনে তাদের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে আভিযোগ ছিল প্রচুর।

শেষ ধাক্কাটা এসেছে অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের কাছ থেকে। বাংলাদেশের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে ফারজানা ইসলাম তখনই এই বিষয়টি বলেন যখন খোদ তাকে ঘিরেই চাঁদা দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি নড়েচড়ে ওঠে এবং পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি নিয়ে প্রায় মাসখানেক ধরে জোরালো আন্দোলন চলছে। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীনগর’—এই স্লোগানকে আঁকড়ে ধরে আন্দোলন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। সামাজিক মাধ্যমে এটি নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়। এই আন্দালনকে ঘিরেই ফারজানা ইসলামের ডাক পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তখন তিনি এই চাঁদার বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং এটিকে কেন্দ্র করে তাকে অসম্মান করার বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীকে জানান। তবে পাল্টাপাল্টি অভিযোগে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম এবং ছাত্রলীগের সদ্য বাদপড়া আলোচিত দুই নেতা।

প্রথম দিন নিজেদের ৬% ‘ফেয়ার’ চাঁদার কথা অকপটে শিকার করে চাঁদাবাজির রাজনৈতিক ‘বৈধতা’র আরজি পেশ করেছিলেন সদ্য বাতিল হওয়া এই নেতা। এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পেরেছে তার কারণ হলো, এতদিন পর্যন্ত এ ধরনের বিষয়ে খোদ আওয়ামী-লীগ থেকেও কোনও ধরনের কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়নি।

ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হুমকি, মারধর, হামলা, মারামারি, গোলাগুলি, অস্ত্রের মহড়া, ভয়ভীতি প্রদর্শন, আর অশোভন আচরণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবাই কমবেশি পরিচিত। এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে মোটেও বিচলিত নয় কিংবা ছিল না ছাত্রলীগ নেতৃত্ব। প্রধানমন্ত্রীও যে বিষয়গুলো নিয়ে এই প্রথম অভিযোগ শুনেছেন তাও নয়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এই চরিত্রে দীর্ঘদিন ধরেই এদেশের মানুষ ত্যক্ত, বিরক্ত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসহায়ত্বই প্রকাশ করেছে। আর এসব কারণেই ছাত্ররাজনীতি থেকে শিক্ষার্থীরা ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশে গৌরবময় ছাত্ররাজনীতি যে অহংকার ছিল, তা মিলিয়ে গেছে বহু আগেই। আর এখন ছাত্ররাজনীতির জৌলুস নেই। তবে আছে ছাত্রনেতাদের জীবন-যাপন আর ক্ষমতার জৌলুস, যার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন সবাইকে।

শুধু এই দুই নেতাই নয়, ছাত্রলীগ নেতাদের মাস্তানি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির কথা সবাই জানে। এবং হলে হলে শুধু একটা ঘুমানেোর জায়গার জন্য গ্রাম থেকে আসা ১৮ বছর বয়সী ছেলেরা এই নেতাদের ধরে। কারণ বেশিরভাগ ছেলের হলের সিটগুলো থাকে ক্ষমতাসীন নেতাদের দখলে। আর এই সিটের বদৌলতে কিছুটা শিশুশ্রমিকের ভূমিকা পালন করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা নতুন শিক্ষার্থীদের। ক্ষমতার দাপট প্রতিষ্ঠিত করতে শুধু বিরোধী সংগঠনকে হল থেকে বিতাড়নেই নয়, গণরুম নামক রুমটিকে নিপীড়নের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আর এই ধরনের ঘটনাপ্রবাহে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব থাকে। আবার কোনও কোনও সময় ক্ষমতাসীন দলের সংগঠনকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার তাগাদা বোধ করে, যেটা আমরা দেখেছি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেশনাল কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে। সেখানে অভিযোগ উঠেছে, ডাকসু নির্বাচন করার জন্য অছাত্রদের ছাত্র বানাতে ভূমিকা রেখেছেন সেই অনুষদের ডিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সংক্রান্ত নিয়মনীতি ভেঙে এর সবই করা হয়েছে ছাত্রলীগের জন্য এবং তাদের অনেকেই এখন ডাকসুর নির্বাচিত নেতা। যদিও এই ধরনের অভিযোগ কেউ স্বীকার করেনি।

বিষয়গুলো যখন এই পর্যায়ে চর্চা হয়েছে, তখন ছাত্রলীগ নেতারা শিক্ষকদের কাছে চাঁদা চাইবেন, সেটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ শিক্ষকরা, রাজনৈতিক নেতারা সবাই মিলেই ছাত্ররাজনীতিকে এই অবস্থায় নিয়ে গেছেন। এদেশে শোভন-রাব্বানীদের তৈরি করার কারখানা চালু আছে অনেকদিন থেকেই। দুই একজনকে বাদ দিয়ে সেই কারখানা বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ করতে হবে এই মাস্তান, চাঁদাবাজ আর নির্যাতক তৈরির কারখানাগুলোকে। সঙ্গে সঙ্গে কারাখানা চালু রাখার কারিগরদেরও চিনতে চেষ্টা করুন সবাই।

Previous articleনাটোরে সভপতি-সম্পাদকের উপর হামলার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের বিক্ষোভ
Next articleনাটোরে বন্যপ্রানী সংরক্ষনে সাইনবোর্ড স্থাপন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here