Home সজাগ অনুসন্ধান মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে নাটোর রাজবাড়ির ৩২ শতবর্ষী বৃক্ষ

মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে নাটোর রাজবাড়ির ৩২ শতবর্ষী বৃক্ষ

908
0

নিজস্ব প্রতিবেদক

আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে নাটোর রাজবাড়ির শতবর্ষ সব বৃক্ষ। গাছের গোড়া থেকে মাটি সরে যাওযায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে শতবর্ষী বৃক্ষগুলো। কর্তৃপক্ষের উদাসিনতার কারনে এরই মধ্যে অনেক গাছ উপড়ে পড়ে গেছে পুকুরে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মারা গেছে বেশ কিছু গাছ।

এই অবস্থায় অতি দ্রুত গাছগুলো রক্ষার জন্য জরুরী প্রদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবী জানিয়েছেন নাটোরবাসী।

সূত্র জানায়, ১৯২০ সালের দিকে নাটোর রাজবংশের রাজা যোগেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর রাজবাড়ির সৌন্দর্য বর্ধন এবং সবুজ,শ্যামল রাজবাড়ি গড়ার জন্য মেহগনি, দেবদারু এবং কাঠ করবী ফুলের গাছ রোপন করেন। বর্তমানে ৬০গাছ রয়েছে শতবর্ষী। এরমধ্যে ৩২টি গাছ রয়েছে হুমকির মুখে।

জেলা প্রশাসনের আওতায় থাকা চারটি পুকুরে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের কারনে শতবর্ষী গাছের গোড়া থেকে সরে গেছে মাটি। মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে থাকা এসব গাছ যে কোন সময় উপড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই বর্ষাকালে পুকুরের পানি বৃদ্ধির কারণে গাছের গোড়া পর্যন্ত ছুঁইছুই অবস্থা। প্রতিনিয়ত গাছের গোড়া থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে থাকা শতবর্ষী বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে, দেবদারু ৫টি, মেহগনী ২২টি, আম গাছ ৫টি।

এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এগুলো হচ্ছে, ডাব গাছ ১৯টি, পাম ট্রি ১টি, খেজুর গাছ ৭টি, কৃষ্ণচূড়া ১টি, কামিনী ফুল গাছ ৩টি, মেহগনি ২০টি, দেবদারু ২, শিমুল ১ এবং পলাশ ফুলের গাছ ২টি।

এছাড়া মারা গেছে বা অস্বিস্ত নেই এমন গাছগুলো হচ্ছে, ইউক্যালিপার্স ৩টি, নারিকেল গাছ ৬টি।

নাটোরের সাংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট খগেন্দ্রনাথ রায় বলেন, রানী ভবানী রাজবাড়ির প্রতিটি জিনিসেরই ঐতিহাসিক নিদর্শণ রয়েছে। এই গাছগুলো সম্ভবত ১৯২০ সালের দিকে রাজা যোগেন্দনাথ রায় রোপন করেছিলেন।

তিনি মেক্সিকো থেকে কাঠকরবী ফুলের চারা এনে এখানে রোপন করেছিলেন। কিন্তু দু:খের বিষয় হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনের উদাসিনতার কারনে শতবর্ষের গাছগুলো আজ নস্ট হয়ে যাচ্ছে। একবার এই গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেলে, এমন গাছ কি আর তৈরী করা সম্ভব হবে? যতদ্রুত সম্ভব গাছগুলো রক্ষায় প্রশাসন ভূমিকা রাখবে।

গাছগুলো রক্ষার পাশাপাশি শতবর্ষী বৃক্ষ মারা যাওয়ার কারণ নির্নয় করতে রাজবাড়ির ভিতরের গাছগুলো পরিদর্শন করেছেন নাটোর সদর উপজেলার বনকর্মকর্তা সথ্যেন্দ্রনাথ সাহাকে। তিনি রাজবাড়ির পুরো গাছগুলো ঘুরে দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, সঠিক পরিচর্যা না থাকায় শতবর্ষের বৃক্ষগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখভালের অভাবে রাজাবাড়ির অনেক গাছে মরক দেখা দিয়েছে। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা গাছগুলোর গোড়ায় মাটির পাশাপাশি পুকুর প্যালাসাইড করে বেধে দেওয়ার কথা জানান বনবিভাগের এই কর্মকর্তা।

তিনি আরো বলেন, নাটোর রাজবাড়ির একেকটি গাছ একেকটি ইতিহাস। কিন্তু দেখভালের অভাবে সে ইতিহাসগুলো নষ্ট হয়েছে। একটি শতবর্ষী গাছ তৈরী করতে অনেক শ্রম-সাধনা করতে হয়েছে। বর্তমানে সে গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেলে এমন একটি গাছ তৈরী করা আর সম্ভব নয়।

তাই আমার পরামর্শ যত দ্রুত সম্ভব শতবর্ষী বৃক্ষগুলোকে রক্ষার জন্য গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়ার পাশাপাশি পুকুর প্যালাসাইড করে বেধেঁ দেওয়া উচিত। না হলে এক সময় পুকুরের ভিতর গাছগুলো পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে।

সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম নান্টু বলেন, রাজাদের আমলের গাছগুলো আজ ধ্বংসের পথে। রাণী ভবানী রাজবাড়ির গাছগুলো একেকটা ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মাছচাষ করতে গিয়ে গাছগুলোকে আজ হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

নাটোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান বলেন, নাটোর রাজবাড়ির ভিতরে চারটি পুকুর জেলা প্রশাসন মাছ চাষের জন্য লীজ দেয়। এই পুকুরে বৈজ্ঞনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের কারণে গাছগুলো আজ হুমখির মুখে। মাছ মাটি খাওয়ার কারণে গাছের গোড়া থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আমরা নাটোরবাসী জেলা প্রশাসনের কাছে দাবী জানাবো, পুকুর লীজের টাকা দিয়ে প্যালা্সাইড করে গাছগুলো রক্ষা করা হোক।

নাটোর সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং রাজবাড়ি ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব আবু হাসান বলেন, পুকুর পাড়ে মাটি ফেলার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। সরকারী কোন উৎস থেকে মাটি পেলে আমরা সেখানে মাটি ফেলবো। চারপাশটা প্যালাসাইড করে বেধে দিতে পারলে তবেই গাছগুলো রক্ষা করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, রাজবাড়ির মুল ফটক থেকে ভূমি অফিস পর্যন্ত কিছু গাছ রয়েছে। সেগুলো রক্ষার জন্য প্যালাসাইড করার জন্য এমপি মহোদয় একলাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তাছাড়া মরা গাছগুলো আমরা নিলামে বিক্রি করার জন্য বনবিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছি।

নাটেরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ শাহরিয়াজ বলেন, নাটোর রাজবাড়ী একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এখানকার নিদর্শনগুলো রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। দিনদিন ভগ্নদশায় পরিনত হচ্ছে।

গাছগুলো রক্ষার বিষয়ে কি প্রদক্ষেপ নিবেন এমন প্রশ্নে জেলা প্রশাসক বলেন, রাজবাড়ির জায়গা আমাদের। আর ভবনগুলো প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের। আমরা রাজবাড়ির কোন সংস্কার কাজ করতে গেলেই তারা বাঁধা প্রদান করে। এজন্য আমরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালি করে গাছগুলো রক্ষার জন্য কোন প্রকল্প গ্রহন করা যায় কিনা, সে বিষয়ে চেষ্টা করছি।

সম্প্রতি নাটোর রাজবাড়ি পরিদর্শনে আসেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনি পুরো রাজবাড়ি পরিদর্শণ করেন। এসময় গণমাধ্যম কর্মীদের সচিব বলেন, ঐতিহাসিক নাটোর রাজবাড়ি সংস্কারের পাশাপাশি গাছগুলো রক্ষার জন্য আমরা তিনটি ধাপে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবো।পরিকল্পনা গুলো বাস্তবায়ন হলে শতবর্ষী এসব বৃক্ষ রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি নাটোর রাজবাড়ি তার ঐতিহাসিক নিদর্শন ফিরে পাবে।

Previous articleসিংড়ায় নৌকা ভ্রমনের নামে অসামাজিক কার্যকলাপ: আটক ৭
Next articleবাগাতিপাড়ায় নদী থেকে মরদেহ উদ্ধার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here