
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের দিনগুলোতে নাটোরের রাজপথে মিছিল-শ্লোগানে প্রকম্পিত করা আওয়ামী যুবলীগ প্রায় দেড় যুগ ধরে চলছে পুর্নাঙ্গ কমিটি ছাড়া। গত ১৯ বছর ধরে নির্বাচিত নেতৃত্ব ছাড়াই চলছে আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হিসেবে খ্যাত জেলা যুবলীগ। ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলার কারনে অবস্থা আরো করুণ উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটিতে।
বিভিন্ন সময়ে নিজেদের স্বার্থে আওয়ামী রাজনীতির সবচেয়ে সক্রিয় এ অঙ্গ সংগঠন নিয়ে ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় মেতে উঠেছেন ক্ষমতায় থাকা স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা। তাদের পছন্দ মতো নেতা-কর্মীদের কমিটিতে স্থান দিয়েছেন।
ফলে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের বিকাশ ও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবে হতাশা প্রকাশ করছেন দুঃসময়ের ত্যাগী অনেক কর্মী-সমর্থক। এ সুযোগে সংগঠনে অনুপ্রবেশ করছে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী হাইব্রিড ও বিভিন্ন দলত্যাগী কর্মীরা। তাদের দাপটে কোণঠাসা দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। এসব নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধে গত সাত বছরে নিহত হয়েছেন ৮ যুবলীগ নেতা-কর্মী।
বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ গ্রহন করে জেলা যুবলীগ।
এলাকায় আধিপত্য, নেতৃত্বে অসম প্রতিযোগিতা, পূর্ব বিরোধসহ নানা কারণে এসব হত্যাকান্ড ঘটছে বলে মনে করছেন তারা। জেলা যুবলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ সংগঠনের নেতাদের একের পর এক এসব হত্যাকান্ডে চিন্তিত। সাবেক নেতাদের মতে, জেলা ও উপজেলা যুবলীগের বর্তমান কমিটিতে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায়, কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় তৃণমূল কর্মীরা দ্বিধান্বিত।
আর বর্তমান কমিটির নেতৃবৃন্দের দাবী, সংগঠনের মধ্যে কোন অভ্যন্তরিন বিরোধ নেই। তবে দলে অনুপ্রবেশকারীরাই এলাকার আধিপত্য নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়লে এসব হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে।
জেলা যুবলীগের বর্তমান দায়িত্বশীল নেতাদের দাবী, সংগঠন এখন সবচেয়ে বেশি সক্রিয় এবং ঐক্যবদ্ধ। নির্বাচিত নেতৃত্ব না থাকায় এখানে নেই কোন বিরোধ। বিশেষ কোন চাওয়া পাওয়া নেই তাদের। তাই সম্মেলন না হওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে না দলীয় কর্মসূচী পালনের ওপর। তবে এই সংগঠনের সাবেক এক শীর্ষ নেতার দাবী নাটোর জেলা যুবলীগ এখন ভঙ্গুর এবং মৃত প্রায়।
দলীয় সুত্রে জানাযায়, ১৯৯৮ সালে নাটোর জেলা যুবলীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ডেলিগেটরদের সরসরি ভোটে সংগঠনের নেতা নির্বাচন করা হয়। নির্বাচনে বর্তমান সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান সভাপতি নির্বাচিত হলেও সাধারন সম্পাদক পদে বর্তমান সাংসদ শফিকুল ইসলাম শিমুল ও প্রতিদ্বন্দ্বি সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বর্তমানে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারন সম্পাদক সৈয়দ মোস্তাক আলী মুকুল সমান সংখ্যক ভোট পাওয়ায় কমিটি ঘোষনা স্থগিত করা হয়।
প্রায় দুই বছর পর ২০০০ সালে শফিকুল ইসলাম শিমুলকে সাধারন সম্পাদক করে জেলা যুবলীগের কমিটি অনুমোদন করে কেন্দ্রিয় কমিটি। পরবর্তীতে শফিকুল ইসলাম শিমুল জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক এবং শরিফুল ইসলাম রমজান ১ নং যুগ্ম সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের পদ দুটি শুন্য হয়।
এছাড়া দীর্ঘ সময়ে সংগঠনের আরো অনেকেই মুল দলে জায়গা করে নেয়ায় পদগুলি শুন্য রয়েছে। ফলে প্রায় শুন্য গোয়াল নিয়েই চলছে যুবলীগের কার্যক্রম। পরে কমিটির সহ-সভাপতি বাশিরুর রহমান খানচেৌধুরি এহিয়াকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং যুগ্ম সাধারন সম্পাদক রুহুল আমিন বিপ্লবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পন করে কেন্দ্রিয় কমিটি। সংগঠনকে গতিশীল করতে উপজেলা ও পৌর কমিটি সকল কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়।
সংগঠনের নেতা কর্মীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় সংগঠনের কার্যক্রমে কোন গতি নেই। নাটোর পৌর যুবলীগের আহবায়ক কমিটি গঠনের পর কেটে গেছে কয়েক বছর। কিন্তু সম্মেলন না হওয়ায় প্রায় স্থবির এই ইউনিটের। দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় বিভিন্ন পদের দাবীদার অনেকেই নিজের পক্ষে প্রচারনা চালাতে গিয়ে ব্যানার ফেস্টুনে যুবলীগের প্রস্তাবিত একটি পদ উল্লেখ করে হাসির খোরাক হচ্ছেন। সদ্য অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় সম্ভাব্য প্রার্থীদের কেউ কেউ পদের আগে প্রস্তাবিত পদ উল্লেখ করেন।
নাটোর পৌর যুবলীগের আহবায়ক সায়েম হোসেন উজ্জল বলেন, তিনি সংগঠনের সম্মেলন করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন। কিন্তু জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দের কোন নির্দেশনা নেই। এছাড়া সংগঠনের কার্যক্রমেও জেলা কমিটির কোন তদারকি নেই। নির্দেশনা বা তদারকি না থাকায় সংগঠনে সুবিধাবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। তাদের কারনেই ঘটছে নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড।
এককালের তুখোর ছাত্র নেতা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও নাটোর পৌরসভার পরপর দুইবারের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তারুল ইসলাম আলম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, সফলভাবে জেলায় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেয়ার পর যুবলীগের নেতৃত্বে আসার ইচ্ছা ছিল। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলা নেতৃবৃন্দ কর্তৃক যুবলীগের নেতৃত্বে আনার শর্তে নৌকা প্রকীকের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে এসেছিলাম। এখন প্রতিশ্রুতি থেকে তারা সরে এসেছেন।
জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান বলেন, আমাদের নেতৃত্বের সময় নাটোরে যুবলীগ কর্মীদের শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত থাকতো। বিএনপি জামায়াতের শাসনামলে যুবলীগ রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। যুবলীগের বর্তমান কমিটিতে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায়, কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় তৃণমূল কর্মীরা দ্বিধান্বিত। কমিটির অনেকেই এখন নেই। শুন্য গোয়াল । জেলা যুবলীগ বস্তুত একটি মৃত প্রায় বা ভঙ্গুর সংগঠন।
তিনি দ্রুত সম্মেলন করে শক্তিশালী যুবলীগ গঠনের তাগিদ দিয়ে বলেন, যোগ্য এবং রাজপথ কাঁপানো উদীয়মান ত্যাগী, বিশ্বস্ত ও নিরাপদ নেতৃত্ব তৈরি করে তার হাতে দায়িত্ব অর্পন করার আহবান জানান।
জেলা যুবলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) বাশিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়া ও সাধারন সম্পাদক রুহুল আমিন বিপ্লব সাবেক এই নেতার অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, কেন্দ্রিয় নির্দেশে তারা ইতিমধ্যে ৫২ টি ইউনিয়নের সবকটি,৭ উপজেলার ৫টি এবং ১০ পৌরসভার ৭টি সম্মেলন করে কমিটি করা হয়েছে। উপজেলা ও সংসদ নির্বাচনের ব্যস্ততার জন্য অন্যগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রের নির্দেশে সকল কর্মসুচী সফলতার সাথে পালন করা হচ্ছে। দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন বিরোধ নেই।
তবে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতা কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনা দুঃখজন বলে মন্তব্য করে এই দুই নেতা বলেন, বিভিন্ন দল থেকে সুবিধাভোগী অনুপ্রবেশকারী এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এই হত্যাকান্ডগুলো ঘটেছে। দলের মধ্যে অভ্যন্তরিন কোন বিরোধ নাই। প্রস্তাবিত পদ উল্লেখ করে যারা ব্যানার ফেষ্টুন টানিয়েছেন,ওই সব উল্লেখিত প্রস্তাবিত কমিটির কোন অস্তিত্ব নেই বলে দাবী করেন এই দুই নেতা।
