দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারী ব্যাংক হিসাবে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড তার সুদীর্ঘ চার দশকের পথচলায় দেশের গার্মেন্টস ব্যবসা সম্প্রসারণ, দ্রুততম সময়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে সর্বপ্রথম ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মাষ্টার কার্ড প্রচলনসহ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে।
ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কার্যক্রম ঋণ বিতরণের অংশ হিসেবে কৃষি ঋণ বিতরণে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ফলে জাতীয় পরিসরে কৃষি ক্ষেত্র নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক এতো ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে যে, সকল কার্যক্রম সকলের পক্ষে জানাটাও সব সময় সম্ভব হয় না। এই আলোচনায় কৃষি ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের অংশগ্রহণমূলক কর্মকান্ড নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
দেশের উত্তরাঞ্চলে বরেন্দ্র প্রকল্পের আওতাধীন এলাকার কৃষি ও আর্থ সামাজিক উন্নয়ন: বর্তমান ব্যবস্থায় পরিচালিত কৃষি ঋণ কার্যক্রমের অনেক আগে থেকেই ন্যাশনাল ব্যাংক সরাসরি কৃষক পর্যায়ে ঋণ বিতরণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে।
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলা তথা উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার অন্তর্গত গভীর নলকূপভূক্ত এলাকাসমূহের কৃষি এবং এসব এলাকার কৃষকদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে এই প্রকল্পের সূচনালগ্ন অর্থাৎ ১৯৯২ সাল থেকে যৌথ উদ্যোগে একযোগে কাজ করে এসেছে। বেসরকারি ব্যাংকসমূহের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডই সর্বপ্রথম বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এসব এলাকায় কৃষি ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে।
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কৃষি ঋণ বিতরণ: বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের উপর নির্ভরশীল। কৃষি খাত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পুষ্টি সমস্যা সমাধান, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সর্বোপরি দেশের অভ্যন্তরীণ মোট উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ঋণ বিভাগ বিগত ২০০৮-০৯ অর্থ বছর থেকে দেশের সকল রাষ্ট্র মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক, রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংক এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে প্রতি অর্থবছর কেন্দ্রিক কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা প্রদান করে আসছে।
লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এমএফআই এর মাধ্যমে ঋণ বিতরণের চাইতে নিজস্ব সক্ষমতায় ঋণ বিতরণের বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কিছু কিছু অর্থবছরে শতভাগ অর্জনের পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত বিতরণের মাধ্যমে বিগত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অনর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ ফেরত আনার ইতিহাসও ন্যাশনাল ব্যাংকের রয়েছে। কৃষকের উপর ঋণভার কম হয় বিধায় ন্যাশনাল ব্যাংক প্রতিনিয়তই সম্মানিত পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজস্ব সক্ষমতায় ঋণ বিতরণ করে আসছে।
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ২৫২.০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত কৃষির বিভিন্ন খাতে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড ১৬,৫৫৫ জন ঋণ গ্রহীতার মাঝে ২০৭.৭১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে যার মধ্যে ১৯২.৭১ কোটি টাকা (৯৩%) নিজস্ব সক্ষমতায় এবং অবশিষ্ট ১৫.০০ কোটি টাকা (৭%) এমএফআই লিংকেজের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৯,১৪৩ জন ঋণ গ্রহীতার মাঝে ২৬৬.০২ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল যার ৯৯ শতাংশই নিজস্ব সক্ষমতায়।
আমদানি বিকল্প ফসল খাতে কৃষি ঋণ বিতরণ: দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে ডাল, তৈলবীজ ও মশলা জাতীয় ফসল ও ভুট্টা চাষে উৎপাদনের জন্য সরকার প্রদত্ত সুদ ক্ষতির বিপরীতে ঋণ বিতরণে ন্যাশনাল ব্যাংক সর্বদাই বদ্ধ পরিকর।
বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪.২২ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫৫০ জন ঋণ গ্রহীতাকে ৪.৯১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এবং চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত ৪.৫০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫০৪ জন ঋণ গ্রহীতাকে ৪.৩৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। আশা করা যায়, এবারো লক্ষ্যমাত্রার বেশী বিতরণ করতে আমরা সক্ষম হব।
ছিটমহল এলাকায় কৃষি ঋণ: বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তিটি বাস্তবায়িত হওয়ায় নতুন করে বাংলাদেশে অর্ন্তভূক্ত হওয়া ১১১টি ছিটমহল বর্তমানে বাংলাদেশ ভূখন্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ অঞ্চলের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ভূমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় তাদের অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি উক্ত অঞ্চলে কৃষি কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তাদের মাঝে কৃষি ঋণ বিতরণ করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
ছিটমহল এলাকার অধিবাসীদের আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান এবং অত্র অঞ্চলে কৃষির সম্ভাব্যতার কথা বিবেচনা করে ২০১৫ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অত্র এলাকায় ভাউলাগঞ্জ শাখা প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভাউলাগঞ্জ শাখা অত্র অঞ্চলের অদিবাসীদের আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য হারে কৃষি ঋণ বিতরণ করে আসছে যা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।
দারিদ্র বিমোচন: নিম্ন আয়ের লোকজনকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং তাদের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড ২০১৬ সালে “দারিদ্র মুক্তি” নামে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে জামানতবিহীন একটি ঋণ প্রকল্প চালু করে। “দারিদ্র মুক্তি” ঋণের আওতায় প্রধানত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও পেশাজীবী শ্রেণী, হস্ত ও কুটির শিল্প এবং প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের অর্থায়ন করা হয়।
কৃষি ঋণের আওতায় এই খাতে প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দকৃত ১৫.০০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে সফলভাবে বিতরণ করা সম্পন্ন হয়েছে। এই কার্যক্রমের অধীনে ৯৩৩ জন মহিলাসহ ২,০২০ জন প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও পেশাজীবীর মাঝে ১৫.০০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ৭০টি পাওয়ার টিলার, ১,৯৫০ জন কৃষকের জন্য গরু পালন, ফসল চাষ এবং মৎস্যসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র আয় উপার্জনকারী খাতে এই ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এভাবে ব্যাংক প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য আয় উপার্জনকারী খাতে বিনিয়গের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের এই প্রচেষ্টা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে।
প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের কল্যাণমুখী কার্যক্রমে ন্যাশনাল ব্যাংকের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ হিসাবে বরগুনা জেলার ১০ জন প্রতিবন্ধী দুস্থ মহিলাদের ঋণ প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। বরগুনায় উক্ত অঞ্চলের নিকটবর্তী কোন শাখা না থাকা সত্ত্বেও কৃষি ঋণের আওতায় ব্যাংকের সর্বাগ্রে স্বল্পসময়ে দ্রুততার সাথে উক্ত ঋণ বিতরণ করেছে যা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।
কোভিডকালীন সময়ে প্রণোদনা প্যাকেজ: কোভিড-১৯ অতিমারি পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকা এবং ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। প্রথম পর্যায়ে ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ন্যাশনাল ব্যাংকের জন্য বরাদ্দকৃত ১২২ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৭৩৯ জন গ্রাহকের মধ্যে ৪৯.৪১ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘোষিত ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ২১১৭ জন গ্রাহকের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২৫ কোটি টাকা শতভাগ বিতরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচীতে ন্যাশনাল ব্যাংক: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গৃহিত প্রত্যেকটি জনবান্ধব কর্মসূচীতে আমাদের ব্যাংক সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছে। দেশের গম ও ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ১ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়নের আওতায় ন্যাশনাল ব্যাংক প্রথম পর্যায়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত ৫.০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ ২৭২ জন গ্রাহকের মধ্যে বিতরণ করেছে। একই খাতে দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২৩-২০২৫ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত ২৫ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ফেব্রুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত ১১৬০ জন ঋণ গ্রহীতার মধ্যে ১০.৫৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
এছাড়াও চলমান ‘‘ঘরে ফেরা’’ বিষয়ক পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় ন্যাশনাল ব্যাংকের জন্য বরাদ্দকৃত ৫ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ফেব্রুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত ২৭২ জনের মাঝে মোট ২.৭২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গঠিত ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়নের আওতায় ন্যাশনাল ব্যাংকের জন্য বরাদ্দকৃত ৫৫ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ফেব্রুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত ২৮১৮ জনের মাঝে ২৬.২৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ সকল লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের বিশদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আলোচনায় পরিশেষে এটাই উল্লেখ করা যায় যে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশেষত কৃষি ঋণ বিতরণে ন্যাশনাল ব্যাংকের অবদান ঈর্ষণ্বীয়। আগামীতেও এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।