বিশ্বে নতুন একটি যুদ্ধধারা সূত্রপাত করে আমেরিকায় সেপ্টেম্বর ইলেভেন। এই ঘটনা গোটা বিশ্বকেই নাড়া দেয়। এই ঘটনার জের ধরে, আফগান যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ এবং লিবিয়া যুদ্ধ- এই তিনটি যুদ্ধ পরিচালনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন-আফগান যুদ্ধ হলো ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান আক্রমণের পর সৃষ্ট যুদ্ধ। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানকে আল-কায়েদার কার্যক্রমের নিরাপদ ঘাঁটি হিসাবে অস্বীকার করার জন্য সাময়িকভাবে তালেবানকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে।
প্রাথমিক উদ্দেশ্যসমূহ সম্পন্ন হওয়ার পর, ৪০ টিরও বেশি দেশের একটি জোট (সমস্ত ন্যাটো সদস্যসহ) আফগানিস্তানে ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়তা বাহিনী’ (আইএসএএফ, ২০১৪ সালে রেজোলিউট সাপোর্ট মিশন (আরএস) দ্বারা সফল) নামে একটি নিরাপত্তা অভিযান গঠন করে, যার কিছু সদস্য আফগানিস্তান সরকারের সাথে জোটবদ্ধভাবে সামরিক যুদ্ধে জড়িত ছিল।
যুদ্ধটি মূলত আফগান সশস্ত্র বাহিনী ও সহযোগী বাহিনীর বিরুদ্ধে তালেবান বিদ্রোহ নিয়ে গঠিত; আইএসএএফ/আরএস সৈন্য ও কর্মীদের অধিকাংশই ছিল আমেরিকান। এই যুদ্ধের নাম ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন এন্ডুরিং ফ্রিডম ও অপারেশন ফ্রিডম সেন্টিনেল।
জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পর দাবি করেন যে- তৎকালীন আফগানিস্তানের শাসক তালেবান ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করবে। তালেবান তাকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করায় অপারেশন এন্ডুরিং ফ্রিডমের শুরু হয়। তালেবান ও তাদের আল-কায়েদা মিত্রদের বেশিরভাগই মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী ও ১৯৯৬ সাল থেকে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসা উত্তর জোটের দ্বারা পরাজিত হয়।
বন সম্মেলনে, নতুন আফগান অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ (বেশিরভাগই উত্তর জোট থেকে) হামিদ কারজাইকে আফগান অন্তর্বর্তী প্রশাসনের প্রধান নির্বাচিত করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কাবুল সুরক্ষিত করার সাথে সাথে নতুন কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করার জন্য আইএসএএফ প্রতিষ্ঠা করে। তালেবান শাসনের অবসানের পর দেশব্যাপী পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাও করা হয়। প্রাথমিক আক্রমণে পরাজয়ের পর, মোল্লা ওমর তালেবানকে পুনর্গঠিত করেন এবং আফগান সরকারের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালে বিদ্রোহ শুরু করেন।
শেষ ফলাফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান দোহায় ২০২০ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি একটি শর্তসাপেক্ষ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে বলা হয় যে- ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে, পরিবর্তে তালিবান চুক্তির শর্তাবলী অনুযায়ী ‘আল-কায়েদাসহ-এর কোনো সদস্য, অন্যান্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে এমন কার্যক্রম করার অনুমতি দিন প্রদান করবে না’।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট’ অনুসারে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধে আফগানিস্তানে ১,৭১,০০০ জন থেকে ১,৭৪,০০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়; যার মধ্যে ৪৭,২৪৫ জন আফগান বেসামরিক নাগরিক, ৬৬,০০০ জন থেকে ৬৯,০০০ জন আফগান সামরিক ব্যক্তি ও পুলিশ এবং কমপক্ষে ৫১,০০০ জন বিরোধী যোদ্ধা রয়েছে। মার্কিনি হতাহতের সঠিক পরিসংখ্যান এখনও অজ্ঞাত!
ইরাক যুদ্ধ, মার্কিন অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম নামেও পরিচিত। অন্য নাম, অপারেশন টেলিক, ইরাক দখল। একটি চলমান যুদ্ধ যা ২০০৩ সালের ২০শে মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এই আগ্রাসী বাহিনীতে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড এবং অন্যান্য কয়েকটি জাতির সৈন্যদল অংশ নিয়েছিল।
ইরাক আক্রমণ করার জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ও কোয়ালিশন বাহিনী যে কারণ দেখিয়েছিল তা হলো- ইরাক ১৯৯০ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুদও আছে।
তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিল- ইরাক যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড়ো ধরনের হুমকি। পরবর্তীতে এ সমর্থক কর্মকর্তাদের প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয়। কারণ আগ্রাসনের পরে পরিদর্শকরা ইরাকে গিয়ে কোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পায়নি।
তারা জানায়, ইরাক ১৯৯১ সালেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ ত্যাগ করেছে, ইরাকের উপর থেকে আন্তর্জাতিক অনুমোদন সরিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের নতুন করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনাও ছিল না।
এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা যা কিছু অস্ত্র পাওয়া গেছে আগেরগুলোরই ভগ্নাবশেষ। এগুলোর জন্য মার্কিন বাহিনী ইরাক আক্রমণ করেনি। কোনো কোনো মার্কিন কর্মকর্তা দাবি করেন যে, সাদ্দাম হোসেন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করছেন, কিন্তু এর পক্ষেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারপরও আগ্রাসনের কিছু কারণ দেখানো হয়েছে- যা ছিল খুবই দুর্বল।
আগ্রাসনের পরপরই কোয়ালিশন বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং ইরাকের বিভিন্ন পন্থি দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে অপ্রতিসম বিভিন্নমুখী আক্রমণের মাধ্যমে ইরাকি অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে। সুন্নি এবং শিয়া দলগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং আল-কায়েদা ইরাকে তাদের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে। এই যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা আনুমানিক ১৫০,০০০ থেকে ১০ লক্ষের বেশি।
যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ৮৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি, আর যুক্তরাজ্যের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ইউরো। উল্লেখ্য এই সময়ে মার্কিন অর্থনীতির মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে। এক পর্যায়ে কোয়ালিশনের বেশ কিছু রাষ্ট্র ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। গণ অসন্তোষ এবং ইরাকি বাহিনীর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার কারণেই এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মার্কিন তেল বাণিজ্য উপদেষ্টা ফালাহ্ আলজিবারি দাবি করেছেন- ২০০১ সালে বুশ ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই ওয়াশিংটন, মধ্যপ্রাচ্য ও ক্যালিফোর্নিয়াতে ইরাকের বর্তমান সরকার উচ্ছেদ বিষয়ে গোপন মিটিং শুরু করেছিলেন।
আলজিবারি বিবিসি-কে বলেছেন, তিনি বুশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাদ্দাম হুসাইনের প্রভাবশালী উত্তরসূরিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। লিবিয়া যুদ্ধে মার্কিনি ভূমিকা কাঁপিয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে। ২০০৩ সালের ১-লা মে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মার্কিন রণতরী ইউএসএস আব্রাহাম লিঙ্কনের ওপর দাঁড়িয়ে ইরাকে মূল সামরিক অভিযান সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর পেছনে টাঙানো ব্যানারে লেখা ছিল ‘মিশন সম্পন্ন’।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান শুরুর মাত্র ৪৩ দিনের মাথায় নাটকীয় ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বুশের ওই ঘোষণার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছিল, ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’-এর একটি পর্ব শেষের সূচনা। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অভিযান শেষ হওয়া থেকে অনেক দূরে।
এরপরে যুক্তরাষ্ট্র আরও সেনা পাঠাতে থাকে ইরাকে। সেখানে তাদের সেনার সংখ্যা সর্বাধিক হয় ২০০৭ সালে, ১ লাখ ৬৮ হাজার। যদিও ২০০১ সালের ৯/১১ নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে চালানো ওই সন্ত্রাসী হামলায় ইরাকের সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য-প্রমাণ ছিল না।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র তার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরও বিস্তৃত করে। নিজেরা সামরিক অভিযান ও হামলা চালানোর পাশাপাশি কখনো কখনো সহযোগী দেশের বাহিনী দিয়ে ২০টির বেশি দেশে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয় তারা। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যাদেরই হুমকি মনে করেছে, সেসব দেশেই কথিত এই যুদ্ধ ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ব্রেনান সেন্টার ফর জাস্টিসের লিবার্টি অ্যান্ড ন্যাশনাল সিকিউরিটি কর্মসূচির পরামর্শক ক্যাথেরিন ইয়ন ইব্রাইট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ সব সাবেক প্রেসিডেন্টের প্রশাসনগুলো ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নিয়ে যেসব কথা বলেছে ও কৌশল নিয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে গণতান্ত্রিক জবাবদিহির ঘাটতি ধরা পড়বে।
মার্কিনি যুদ্ধ ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফি সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে কীভাবে লাভবান হয়েছে- তা অনেকভাবেই বিশ্লেষণ করা যায়। কিন্তু মূলত যুদ্ধটি ছিল প্রতিপত্তি বিস্তারের। সেটাই আজ প্রমাণিত হচ্ছে দিনে দিনে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুসারে, কেবল কংগ্রেসেরই যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমনটি কখনো ঘটেনি।
তার বদলে দেশটির নেতারা যুদ্ধের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য আইনি মারপ্যাঁচের পথে হেঁটেছে- বিশেষত এ ক্ষেত্রে দেশটির অভ্যন্তরীণ আইন ব্যবহার করেছে। তাঁরা বহির্বিশ্বে তাঁদের সামরিক অভিযানকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ‘সন্ত্রাসীদের’ হুমকি মোকাবিলার বিষয় হিসেবে প্রচার করেছে।
যদিও তাঁদের এই আইনি ন্যায্যতার দাবি ধোপে টেকে না। বিশ্লেষকদের মতে, আসলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুপক্ষগুলোর বিরুদ্ধে নির্বাহী বিভাগ তথা হোয়াইট হাউস, প্রতিরক্ষা বিভাগ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বিপুল ক্ষমতা ব্যবহার করে।
২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার ঘটনায় সামরিক অভিযানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে দ্য অথরাইজেশন ফর ইউজ অব মিলিটারি ফোর্স (এইউএমএফ) আইন গৃহীত হয়। এই আইনের সুযোগ নিয়ে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই সন্ত্রাস মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র অভিযান চালাতে পারে। ২০০১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর এইউএমএফ আইন পাস হয়। এই আইন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ৯/১১ হামলার জন্য দায়ী দেশ, সংস্থা বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট এককভাবে পরিকল্পনা সাজাতে, সামরিক অভিযানের অনুমোদন দিতে, কোনো পক্ষের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে ও সামরিক অভিযানে সাহায্যকারী দল নির্বাচন করতে পারবেন।
২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান এই আইনের মাধ্যমে বৈধতা পায়। পরে আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেটসহ (আইএস) বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এই আইনকে ব্যবহার করা হয়। এই আইনের সংশোধনী পাস হয় ২০০২ সালে। তার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী সময়ে ইরাক ও সিরিয়ায় অভিযান চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি’ প্রকল্পের সহপরিচালক স্টেফানি স্যাভেল ২০২১ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০০১ সাল থেকে জিবুতি, লিবিয়া, পাকিস্তান, সোমালিয়া ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন বিমান হামলা এবং সামরিক অভিযানকে বৈধতা দিতে এইউএমএফ আইন ব্যবহার করা হয়। একই সঙ্গে ক্যামেরুন, চাদ, ইরিত্রিয়া, জর্জিয়া, কসোভো, জর্ডান, নাইজেরিয়া ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে মিত্রদের অভিযানে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই আইন ব্যবহার করা হয়।
এই পরিসংখ্যান যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ সম্পৃক্ততার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না বলে জানিয়েছেন স্যাভেল। তাঁর বিশ্লেষণ মতে, শুধু ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল- এই দুই বছরে ওয়াশিংটন ৮৫টি দেশে এ ধরনের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ কার্যক্রম চালিয়েছে।
এসব কার্যক্রমের মধ্যে বিমান হামলা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দেশের সেনাবাহিনীকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়গুলোও রয়েছে। তিনি বলেন, বাইডেন প্রশাসনের প্রথম এক বছরের কার্যকলাপও একই পথে হেঁটেছে।
বিশ্বে এখন ইউক্রেন-রাশিয়া, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দুটি বড়ো যুদ্ধ চলছে। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। জাতিসংঘের ভূমিকা এখানে গৃহপালিত জীবের মতো! কিন্তু কথা হচ্ছে, রক্তের বিনিময়ে তো শান্তির আশা করা যায় না! বিশ্বে রক্তপাত থামাতে হলে, এখন যেকোনো শান্তিপ্রস্তাবকেই প্যালেস্তাইন সমস্যার বিষয়টি বিচার-বিবেচনা করতে হবে।
এমনকি সাদ্দাম পরাজিত হলেও, তাঁর জাগিয়ে তোলা আরব জাতীয়তাবাদ এমনকি আগামী দিনগুলিতে আমেরিকাকে লাগাতার তাড়িয়ে বেড়াবে। এর ভিত্তিতে, ফ্রান্স ও অন্য ইউরোপীয় দেশগুলি স্বাধীন রাজনৈতিক উদ্যোগের পথে পা বাড়াবে যা মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ হতে বাধ্য। মার্কিন-সোভিয়েতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের বর্তমান পর্যায়টি এক উত্তপ্ত উত্তেজনাময় শান্তিতে পরিণত হতে পারে।
আর, মার্কিনবিরোধী ঢেউ-এর যে প্লাবন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে লক্ষণীয় তা নিশ্চিতভাবেই এক নতুন রাজনৈতিক মেজাজ নিয়ে আসবে। এই স্নায়ুযুদ্ধের পরিণতি যাই হোক না কেন, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে- মার্কিনের এককেন্দ্রিক বিশ্বের স্বপ্নের সলিল সমাধি হতে পারে একসময়।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন চলাকালীনই বর্তমান বিশ্বের দুই প্রধান শক্তির মধ্যে যুদ্ধের দামামা! আমেরিকার এয়ারফোর্সের এক জেনারেল তাঁর নেতাদের জানিয়েছেন, তাঁর মন বলছে, আগামী দু’বছরের মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে আমেরিকা। যদিও পেন্টাগনের তরফে এমন ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু চার তারকাসম্পন্ন জেনারেল মাইক মিনিহানের মনের কথা নিয়ে হুলস্থূল পড়ে গিয়েছে বিশ্বজুড়ে। আমেরিকার এয়ারফোর্সের ‘এয়ার মবিলিটি কম্যান্ড’-এর প্রধান জেনারেল মাইক যে গোষ্ঠীতে কাজ করেন তার সদস্যসংখ্যা ১ লক্ষ ১০ হাজার। মাইক তারই শীর্ষনেতৃত্বকে লিখিত ভাবে (মেমো) যুদ্ধের আগাম আঁচ দিয়েছেন।
আমেরিকার সামরিক বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বলছেন, মাইকের মনের ভাবনা পেন্টাগনের ভাবনার পরিপন্থি। কিন্তু আমেরিকার সেনার একেবারে শীর্ষস্তরে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে যে কী পরিমাণ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা বোঝা যায়। এই উদ্বেগের ভরকেন্দ্রে রয়েছে তাইওয়ান।
আমেরিকার দাবি, চিন সেখানে বলপূর্বক নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টায় রত। যা বাইডেনের প্রশাসনের কাছে দিনে দিনে চক্ষুশূল হয়ে উঠছে। মাইকের ‘মনের ভাবনা’য়ও তারই সুর। মাইক মনে করছেন, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪-এ যখন তাইওয়ান এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, উভয়েই প্রেসিডেন্ট ভোটে যাবে সেই সময় চীন তাইওয়ানের উপর সামরিক কার্যকলাপ শুরু করতে পারে। তাতেই যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
কারণ, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের অন্যতম উপাদান সেমি কন্ডাক্টর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমেরিকা তাইওয়ানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছুটছে। তাই তাইওয়ানে চীনের ‘আগ্রাসন’ আমেরিকার কাছেও বিপদসঙ্কেত স্বরূপ। যদিও মাইকের এই মন্তব্যকে সত্যি বলে স্বীকার করেনি পেন্টাগন। আমেরিকার এক প্রতিরক্ষা আধিকারিক বলেন- ‘‘এই ধরনের মন্তব্য চীন নিয়ে বিভাগের মনোভাব প্রদর্শন করে না।’
ঘটনাচক্রে, তাইওয়ানে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েম চীনের লক্ষ্য। সে জন্য প্রয়োজনে যে শি জিনপিংয়ের দেশ বলপ্রয়োগেও পিছপা হবে না, চলতি ঘটনাপ্রবাহ থেকেই তা স্পষ্ট। তেমন হলে আমেরিকাও যে পিছিয়ে যাবে না, এমনটাও মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু লড়াই যদি সত্যি বেধে যায়, তা হলে কী হবে? আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ভরকেন্দ্র হিসাবে রকেটগতিতে উঠে আসা চীনকে আটকে দেওয়া কি আমেরিকার পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে? ঠিক তেমনই এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদণ্ড আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি টক্করে গিয়ে আখেরে কী লাভ হবে চীনের?
সামান্য আলোকপাত করি রাশিয়া বিষয়ে। রাশিয়া এখন একটি বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তি- যারা নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও প্রভাবের জায়গা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এই দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের মধ্যে না পড়লেও, আন্তঃপুঁজিবাদী রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়বে।
মার্কিন-চীন সংঘাত আরেক নতুন পাঠ! চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে উদ্বিগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর চীনই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। প্রযুক্তিভিত্তিক শক্তিতেও বিপুলভাবে অগ্রসর হচ্ছে চীন।
চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই)-এ ৬০টির বেশি দেশ অংশগ্রহণ করছে- যা তাদের ভূরাজনৈতিক ব্যাপ্তির এক শক্তিশালী নিদর্শন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ান দেশগুলি, জাপান চীনের অর্থনৈতিক সহযোগী ও বাণিজ্যিক অংশীদার।
এরা কেউ চীন বিরোধী প্রচারে লিপ্ত হতে চায় না। শুধুমাত্র ভারত ও অস্ট্রেলিয়াই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর সংযুক্ত মার্কিনী কৌশলে সম্পূর্ণভাবে যোগ দিয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান মার্কিন-চীন সংঘাত হলো সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব। এই সময়ের একটি সাম্রাজ্যবাদী হীন ষড়যন্ত্রের নমুনা হলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি খারিজের চেষ্টা। গত ৫ দশকে স্বাক্ষরিত প্রতিটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি তারা খারিজ করতে চাইছে।
যা হলো- ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি, স্ট্রাটেজিক আর্মস রিডাকশন ট্রিটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রাসী নীতি ইরান, ভেনেজুয়েলা, কিউবার বিরুদ্ধে এবং চীনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের কৌশলের কেন্দ্রিকরণ। যা আগামীদিনের জন্য বাড়িয়ে তুলছে সশস্ত্র সংঘর্ষ ও আগ্রাসনের আশঙ্কা।
এই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে শান্তি আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাকে। প্রথম কথা বর্তমান সময়ে শান্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। এখন শান্তি আন্দোলনকে সংগ্রাম চালাতে হয় যুদ্ধের কারণগুলির মোকাবিলাতেও।
সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত বিদ্বেষ ও সংঘর্ষ, মৌলবাদী হিংসা, সন্ত্রাসবাদ, রাজনৈতিক স্বৈরাচার, সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য এসবের বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলন বিশ্বজুড়ে সরব। শান্তি আন্দোলন মানবাধিকার, তথ্যের অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকারের স্বার্থে সক্রিয়। শান্তি আন্দোলনকে পরিবেশ রক্ষার পক্ষেও লড়তে হয়। দাঁড়াতে হয় আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি শাসিত সাম্রাজ্যবাদী নয়া উদারবাদ ও বিশ্বায়নবিরোধী সংগ্রামের পাশে।
আগেই বলেছি, অস্ত্রযুদ্ধের পাশে স্নায়ুযুদ্ধ এখন বড়ো যন্ত্রণা! আর এর প্রধান হোতা হচ্ছে মিডিয়াদুনিয়া। মার্কিনি মিডিয়াগুলো একতরফাভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসনকে সমর্থন করেই যাচ্ছে। এখানে মিলিয়ন ডলার দিয়েও, ফিলিস্তিনি মানুষের আর্তনাদ মিডিয়ায় প্রচার করা যায় না। সম্ভবও নয়। তাহলে ফ্রিডম অব স্পিচ-এর সংজ্ঞাটা কী?
লোভি রাজনৈতিক মানসিকতা বিশ্বশান্তির প্রধান অন্তরায়। মার্কিনি একচোখা নীতি বিশ্বকে উত্তপ্ত কড়াইয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ যে আত্মজীবনী লিখেছেন তার শিরোনাম ‘ডিসিশন পয়েন্টস’।
জর্জ বুশ সেই বইয়েই লিখেছেন- ইরাকে কোনো পরমাণু অস্ত্র পাওয়া যায়নি। তবে ইরাকে যে গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি সে বিষয়ে তার মনের ভিতর সবসময় একটা ‘বিরক্তিকর অনুভূতি’ কাজ করছে। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করাটা যুক্তিযুক্ত ছিল। ‘
আমেরিকা এখন নিরাপদ। সাদ্দাম ছিল একজন বিপজ্জনক স্বৈরাচার, যে গণবিধ্বংসী অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল এবং মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদে মদদ জোগাচ্ছিল।’ শান্তি চাইলে মিথ্যার বীজ বপণ বাদ দিতে হবে।
মনে রাখা দরকার- প্রজন্ম কিন্তু এখন অনেককিছুই মিলিয়ে দেখার ক্ষমতা লাভ করছে। এই সক্ষমতাই একদিন হবে শান্তিকামী মানুষের বুক ও বিবেকের হাতিয়ার।
ফকির ইলিয়াস: কলাম লেখক, কবি ও সাংবাদিক